সৌদি ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয় বিশ্ব, আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি
অনুসন্ধানী সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যায় দুই সপ্তাহ ধরে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও অবশেষে কনস্যুলেট ভবনে তাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে রিয়াদ। তবে তাদের ভাষ্য, কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাতাহাতির এক পর্যায়ে খাশোগিকে হত্যা করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি ব্যাখ্যাকে বিশ্বাসযোগ্য আখ্যা দিলেও সিনেট গোয়েন্দা কমিটির সদস্যসহ বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতা তা মানতে নারাজ। খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেওয়া সৌদি আরবের এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন রাজনীতি বিশ্লেষকরাও। জাতিসংঘ এ ঘটনায় ‘গভীর বিরক্তি’ প্রকাশ করেছে। এক ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা বলছে, সৌদি আরবের এই দাবি ঘটনা তদন্তে তাদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি তুলেছে তারা।
গত ২ অক্টোবর খাশোগি নিখোঁজের পর থেকেই সৌদি আরব দাবি করে আসছিলো, তিনি ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেট থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। শনিবার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রথমবারের মতো দেশটি স্বীকার করে, খাশোগিকে কনস্যুলেট ভবনের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে। পাশাপাশি এ ঘটনায় জড়িত দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বহিস্কারের কথাও জানায় দেশটি। সৌদি আরব যখন হত্যাকাণ্ডের স্বীকারোক্তি দেয়, রিয়াদ আর ইস্তাম্বুলে তখন মধ্যরাত। তুরস্কের এক কর্মকর্তা বলেছেন, আঙ্কারার দিক থেকে মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি।
জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে তার মুখপাত্র জানিয়েছেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিক খাশোগির মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গভীর হতাশা ব্যক্ত করেছেন অ্যান্তোনিও গুতেরেস। খাশোগির পরিবার ও স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ-স্বচ্ছ তদন্তের মধ্য দিয়ে দোষীদের বিচার নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
খাশোগি হত্যাকে ভয়ঙ্কর ঘটনা আখ্যা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘এটি আমাদের নজরের বাইরে ছিল না।’ কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে খাশোগির হত্যাকাণ্ডকে ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’ বললেও এ নিয়ে সৌদি আবরের পক্ষ থেকে হাজির করা ভাষ্যকে বিশ্বাসযোগ্য ও প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ আখ্যা দেন তিনি। সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মনে করি এটা একটা ভাল প্রথম পদক্ষেপ। এটা একটা বড় পদক্ষেপ। এর সঙ্গে অনেক অনেক মানুষ জড়িত আর আমার মনে হয়, এটা বিরাট পদক্ষেপ।’ তবে সৌদি আরবকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে, এ ঘটনায় সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আপরোপের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন তিনি। তবে নির্মম ওই ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত গভীরভাবে পর্ববেক্ষণে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। তারা জানিয়েছে, অবিলম্বে স্বচ্ছ ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্তের মধ্য দিয়ে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার পক্ষে ভূমিকা রাখবে।
ট্রাম্প সৌদি আরবেরর ব্যাখ্যাকে গ্রহণযোগ্য বললেও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আইন প্রণেতাই এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মার্কিন সিনেটের গোয়েন্দা কমিটির সদস্য ও সিনিয়র ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর অ্যাডাম স্কিফ শুক্রবার রাতে জানিয়েছেন, সকালের দিকেই তিনি ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনার একটি গোপন সংক্ষিপ্তসার পেয়েছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া টেলিফোন সাক্ষাৎকারে স্কিফ অবশ্য কোন গোয়েন্দার রিপোর্ট পেয়েছেন তার নাম প্রকাশ করেননি। তবে ওই বর্ণনার সঙ্গে শনিবার সৌদি কর্তৃপক্ষের দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে মিল আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সৌদি বয়ান ‘বিশ্বাসযোগ্য নয়’। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের আমলে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সামান্থা পাওয়ার টুইটারে বলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষ ‘নিরেট মিথ্যার (খাশোগি কনস্যুলেট ছেড়ে গেছেন) মুখ বদলে ভুল স্বীকারোক্তি (দুর্বৃত্ত অভিযান) দিয়ে দাবি করছে শিয়ালই বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দেখবে মুরগির সঙ্গে কি হয়েছে’।
আলাদা বিবৃতিতে সৌদি পাবলিক প্রসিকিউটর দাবি করেছেন, সৌদি কনস্যুলেটে দেখা করতে যাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে খাশোগির লড়াই হয়। আর তাতেই খাশোগির মৃত্যু হয়। সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য কর্মসূচির পরিচালক জন বি অল্টারম্যান বলেন, সৌদি বিবৃতিতে বলা হয়নি বিপদ জেনেও খাশোগি কেন শত্রুদের এলাকায় প্রবেশ করেছিল। খাশোগিকে বিনয়ী হিসেবে বিবেচনা করা হয় আর যাদের তিনি আগে থেকেই চিনতেন তাদের দেখে তিনি কিভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কনস্যুলেটে প্রবেশে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা তিনি আগেই তার বাগদত্তাকে জানিয়েছিলেন। ফিরে না আসতে তুর্কি কর্তৃপক্ষকে জানাতে তাকে নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। জন বি অল্টারম্যান মনে করেন, সৌদি আরবকে আরও অনেক তথ্য প্রকাশ করতে হবে যা গত দুই সপ্তাহ ধরে তুর্কি এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সংগ্রহ করা তথ্যের সঙ্গে মিলতেও পারে আবার নাও পারে। তিনি বলেন, এটা দীর্ঘদিন ধরে বাকি থাকা বহুদিনের পদক্ষেপের মাত্র শুরু।
খাশোগির হাতাহাতিতে লিপ্ত হওয়ার সৌদি দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন, রিপাবলিকান প্রশাসনের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক এলিয়ট আব্রামস। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তিনি কনস্যুলেটে তাকে ঘিরে থাকা ভীড়ের মধ্যে ছিলেন আর মারামারি শুরু করে দিলেন? এটা গ্রহণযোগ্য হতেই পারে না’।
সৌদি কর্মকর্তারা বলছেন, পুরো অভিযানটির পরিকল্পনা করেন জেনারেল আসিরি এবং কাহতানি সবকিছু জানতেন। কাহতানিই ঘটনাটিকে সহিংসতা পর্যন্ত আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস ওই ভাষ্য প্রসঙ্গে বলছে, রাজ পবিরারের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে কে এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশনা দিয়েছে, তা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায় যুবরাজের ঘনিষ্ঠরা খাশোগি হত্যায় আসিরির ওপরে দায় চাপাতে চাইছে। টাইমস তাদের পূর্ববর্তী অনুসন্ধানে জানিয়েছিল, আসিরিকে বলির পাঠা বানিয়ে যুবরাজকে রক্ষা করতে চাইছে সরকার। ঘটনার জের ধরে এরইমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার উপপ্রধান আহমাদ বিন হাসান আসিরি ও রাজপরিবারের উপদেষ্টা আবদুল্লাহ আল কাহতানিকে বরখাস্ত করেছেন সৌদি আরব।
সৌদি দাবির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সৌদি কর্তৃপক্ষ সংঘর্ষের পর খাশোগি নিহত হয়েছেন বলায় তাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সংস্থার পক্ষে রাওয়া রাঘে শনিবার বলেছেন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাসহ অন্যান্য সংগঠনের কাছে এটা স্পষ্ট যে কী ঘটেছে তা জানা এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত অপরিহার্য। তদন্তের নামে যেন বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা না করা হয়, তা নজরে রাখবে সংস্থাটি।
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামও খাশোগিকে নিয়ে সৌদি আরবের নতুন ব্যাখ্যার ব্যাপারে ‘সন্দিহান’। তিনিও এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন