স্ট্রবেরি, ক্যাপসিকাম সহ নানান সবজি চাষে মুখর ভোলার মেঘনার চর গুলো
ভোলার মেঘনা নদীর মাঝে জেগে ওঠা চর। যতটুকু চর, ততটুকুজুড়েই স্ট্রবেরি ও নানা ধরনের সবজির চাষ। আর এ চিত্র ভোলার মূল ভূখণ্ডের চারদিকে নদীর মধ্যে জেগে ওঠা ছোট ছোট চরের। এসব চরের সংখ্যা প্রায় ৭৫। এর কোনোটি স্বতন্ত্র ইউনিয়ন, আবার কোনোটি অন্য ইউনিয়নের অংশ।
বর্ষায় ওই সব চর জোয়ারে ডুবে যায়, ভাটায় জেগে ওঠে। কোনো কোনো চরে মানুষ টংঘর তুলে, নয়তো মাটির উঁচু ভিটা করে ঘর তুলে বসত করেন। বর্ষায় ডোবা জমির অস্তিত্ব দূর থেকে চোখে পড়ে না। ভাদ্র-আশ্বিনে জোয়ারের উচ্চতা কমতে থাকে। শুকাতে থাকে পলিতে ঢাকা চর। কার্তিক মাস আসতেই সেখানে কৃষকেরা সবজি চাষের প্রস্তুতি নেন।
মদনপুর চরে পৌঁছে নানা ধরনের সবজি ও ফল দেখে মন জুড়িয়ে যায়। কৃষক-শ্রমিকদের ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় সবজি প্যাকেজিংয়ে। ট্রলার পাড়ে সারি করে দাঁড় করানো। এ সবজি ভোলা নয়, খেত থেকে ট্রলার-লঞ্চে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা-লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালীর বাজারে। আর তরমুজ যায় সারা দেশে।
ভোলার মদনপুর চরটি দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের অংশ। এর সঙ্গে আছে সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের অংশ। এ চরাঞ্চলের উত্তরে রাজাপুর ইউনিয়নের ভোলার চর, কানিবগার চর। দক্ষিণে আছে নেয়ামতপুর, ভবানীপুর; তার দক্ষিণে চর জহিরুদ্দিন।
দুর্গম এসব চরে মানুষের বসত যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে চাষাবাদ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে কাচিয়া, রাজাপুর আর মদনপুরে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে।
দেখা যায়, খেতের পর খেত। চিচিঙ্গাখেতের নিচে শশা-খিরা, চারপাশে বেগুন-টমেটো। ঝিঙা, লাফা-বরবটি, ধুন্দুল, কুমড়া, লাউ, নানা রকম মরিচ, ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজ-রসুন, বাদাম, সয়াবিন ও তরমুজ। কী নেই চরে। সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রিয়াজউদ্দিন বলেন, আল্লাহ নিজ হাতে এসব দিয়েছেন।
প্রায় ২৫ বছর চরে এসব আবাদ করছেন নিজামউদ্দিন ফরাজি। বছরের পর বছর চাষাবাদে লাভ-ক্ষতি গুনে বিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। তাই তো মৌসুম শুরুর আগেই ব্যতিক্রমী সব সবজি উৎপাদন করছেন তিনি। এ বছর তিনি প্রায় ৩৫ একর জমিতে আবাদ করেছেন। নতুন সংযোজন করেছেন স্ট্রবেরি। পরীক্ষমূলক ৫ শতাংশ জমিতে স্ট্রবেরি করেছেন। শুরুতে দাম পেয়েছেন ৬০০ টাকা কেজি।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতি বার পেয়েছেন ৩০০ টাকা কেজি। এ পর্যন্ত স্ট্রবেরি ৪৫ কেজি বিক্রি করেছেন। ৩ একরে ক্যাপসিকাম করেছেন ৩ রকমের লাল, হলুদ ও সবুজ। সবুজটা শুরুতে ১২০ টাকা কেজি পেয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার পেয়েছেন ৭০ টাকা। লাল-হলুদ ক্যাপসিকামের দাম পড়েনি তেমন। এখনো ২০০-২২০ টাকা কেজি চলছে। চিচিঙ্গার দাম এ বছর বাড়তেই চায়নি। পেয়েছেন সর্বোচ্চ ২৫ টাকা। এখন ১৫ টাকা।
দেখা যায়, ক্যাপসিকামের খেতের পাশে ব্রকলি, পাতাকপি, ভিট, গাজর, শিমলা মরিচ, বেরাক মরিচ, করলা-চিচিঙ্গা, টমেটো, বেগুন, কুমড়া, বরবটি-বোম্বাই মরিচ। নিজামউদ্দিনের মতো চলে প্রায় দুই হাজার কৃষক সবজি আবাদ করছেন।
নিজামউদ্দিন জানান, মদনপুরের চরে এ বছর ৫ একর জমিতে সবজি আবাদ করেছেন। এ চরের পাশের মধুপুরে (একই ইউনিয়নের অংশ) ৩৫ একর জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন।
নিজামউদ্দিনসহ একাধিক কৃষক বলেন, কার্তিক মাসে তাঁরা চরে এসে জমির চারপাশে রিংবাঁধের মতো মাটি কেটে উঁচু পাঁচিল গাঁথেন। এরপর জমিতে থাকা বন-জঙ্গল পরিষ্কার করেন। তারপর কলের লাঙল চালান। বীজতলা তৈরি করেন। চারা বড় হলে ঝাঁপি বাঁধেন।
খরিপ-২ আর রবি মৌসুম মিলিয়ে সাত মাসের (কার্তিক-বৈশাখ) একটি মৌসুম বানিয়ে ফেলেন। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে, এই সাত মাসের আয়ে কৃষকের বারো মাসের সংসার চলে। কিছু সঞ্চয়ও থাকে। আবহাওয়া বৈরী হলে ঋণের বোঝা মাথায় নিতে হয়।
নিজামউদ্দিন জানান, সবজিখেতের পাঠ শেষে বৈশাখে ওই জমিতে বোনেন ধঞ্চে। নইলে বোনা আমন ছিটিয়ে দেন (বাইন)। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে বেড়ে ওঠে সে ধঞ্চে, নয়তো ধান। ধঞ্চের খুঁটি সবজিখেতে কাজে লাগে। চলতি বছরে সব মিলিয়ে তাঁর সবজিখেত থেকে ৩০-৩৫ লাখ টাকা বিক্রি আসবে। খরচ হবে প্রায় ২০-২২ লাখ টাকা।
কয়েকজন কৃষক বলেন, ঢাকার বাজারে সিন্ডিকেটের কারণে চাষিরা সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। আবার যাতায়াত খরচ পড়ছে বেশি। সরকারের উচিত লঞ্চঘাটে কৃষিপণ্য টোল-ফ্রি করে দেওয়া। পথ খরচ আর সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকেরা লাভ পাচ্ছেন না।
ভোলার খামারবাড়ি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু মো. এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমি ভোলায় এসেছি মাস দুই হলো। মাঝের চরে এসেছি এই প্রথম। এ চরের বৈচিত্র্যময় ফসল দেখে আমি আপ্লুত, বিমুগ্ধ, আনন্দিত হয়েছি। এখানে (মদনপুর, কাচিয়া ও রাজাপুর ইউনিয়নে) সহস্রাধিক হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হচ্ছে।
রবি মৌসুমের ফসল ছাড়াও কয়েক শ হেক্টরে আগাম (খরিফ-১) মৌসুমের চিচিঙ্গা, করলা, দুন্দুল, ঝিঙাও আবাদ হচ্ছে। তেমনি কয়েক শ হেক্টরে কয়েক রকমের ক্যাপসিকাম, শিমলা মরিচ আবাদ হচ্ছে, যা ঢাকার বাজারে খুবই দামি সবজি। কিছু জমিতে স্ট্রবেরি আবাদ হতে দেখছি। ভোলা জেলায় চলতি বছরে ৫ হাজার ৫৫০ হেক্টরে তরমুজ আবাদ হয়েছে। এই তরমুজ এ রকম নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরেই উৎপাদিত হচ্ছে।
এসব চরের যে উর্বরতা আর ফসলের যে বৈচিত্র্য, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তবে এসব পরিত্যক্ত চরের কৃষক কিছু সমস্যার কথা বলেছেন, সে সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন