স্নেহা ও একটি কদম || তানজিদ শুভ্র

০১

খাবার টেবিলে বসে আম্মুর রান্নার প্রশংসা করছিলাম। আব্বু-আম্মু, বড় ভাই, ভাবি, ছোট বোন স্নেহা আর ভাইপো নিবিড়ও ছিল টেবিলে। আম্মু আর ভাবি খাবার পরিবেশন করছিল। আম্মুর প্রশংসা শুনে স্নেহা ভাবিকে বলছিল, “আম্মুর প্রশংসা না করে আরেকটা ভাবি আনলেই তো হয়। কি বল ভাবি?” স্নেহা ক্লাস নাইনে পড়ে। খুব চঞ্চল হলেও আমার আদুরে বটে। স্নেহার কথায় কান না দিয়ে খাওয়া শেষ করে নিলাম। আমার রুমে যাওয়ার আগ মুহূর্তে নিবিড় এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সাবির আংকেল, সাবির আংকেল, কালকে তুমি আমায় বাড়ি নিয়ে যাবে?”

নিবিড়ের কথায় মনে পড়ল কাল সকালে আমাকে গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। নিবিড়কে নিয়ে যাওয়ার আশা দিয়ে আমার রুমে গেলাম। কিছু কাগজপত্র গোছানোর পর ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল ফজরের আজান শুনে। ভাবলাম সকাল সকাল বের হলে কাজ শেষে বিকাল নাগাদ বাসায় ফিরতে পারব। শনিবার অফিস বন্ধ থাকবে বিশেষ কারণে। বিশ্রামটা তখনই হয়ে যাবে। আমি বের হওয়ার সময়ও নিবিড় ঘুমে। তাই আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াল না।

০২

সকালের স্নিগ্ধ আলোয় হেঁটে হেঁটে রেল স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চেপে বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করলাম। ট্রেনের ঝক ঝক ছুটে চলার মাঝে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।ভালোই হয়েছে, ঘুমে ঘুমে চলেই এসেছি।

ময়মনসিংহ জংশন। রেল থেকে যাত্রিরা নামা শুরু করতে না করতেই কুলিদের হাঁক ডাক শুরু। আমার তো তেমন কোন ব্যাগই নেই। একটা ব্যাগ তো কাঁধেই মানানসই। সেখানেই ঝুলিয়ে পা বাড়ালাম। গ্রামের রাস্তায় সে বহুদিন পর। ভ্যানে করে বাড়ি ফেরার আনন্দ কি আর মিস করা যায়? কিছু কাজের লোক কাজ করছিল। একটু তদারকির দকরার ছিল। সেজন্যই আমার আসা। অনেকদিন পর গ্রামের ফসলি খেতের আইল ধরে হাঁটতে লাগলাম। দুপুরের আগে বাড়ি ফিরে জুম্মায় যাবো ভেবে নিলাম। তাই, দ্রুত হেঁটে বাড়ি আসলাম।

গোসল করতে যাব তখনই দৃষ্টি গেল পুকুরে। দুদিন বৃষ্টি পড়ে গ্রামের পুকুরগুলো পানিতে টইটুম্বুর। অনেকদিন পুকুরে সাঁতার কাটা হয় না। তাই ভরা পানিতে সাঁতার কেটে গোসল শেষে মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষে চাচাকে নিয়ে দাদা-দাদির কবর যিয়ারত করতে পারিবারিক কবরস্থানে গেলাম। বর্ষার বাদলায় পথে একটু কাঁদা বেশি হয়ে গেছে। কবর যিয়ারত শেষে বাড়ি ফেরার সময় পায়ের কাছে কদম ফুল দেখলাম। বর্ষাকালের অন্যতম প্রধান ফুল কদম। উপরের দিকে তাকাতেই দেখি গাছ ভরে আছে কদম ফুলে। কদম ফুল স্নেহার খুব প্রিয়। ওকে নিয়ে দিব ভেবে কয়েকটা কদম নিলাম।

০৩

বাড়ি এসে চাচা-চাচির সাথে দুপুরের খাবার শেষে বাসায় ফিরব বলে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল। এ তো থামার নামই নেই। আমি ফিরব কি করে? আগে তোজংশনে পৌঁছুতে হবে। পরে না হয়, রেলের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখব। কিন্তু, আমি তো বাড়ি থেকেই বের হতে পারছি না। আবার, এই সুযোগে চাচি বলছে- “বাবা, সাবির, অনেকদিন পর তো এবার বাড়ি আসলি। একটা রাত না হয় থেকেই যা!” চাচির অনুরোধ ফেলতে পারছি, বৃষ্টিও কমছে না। কাল তো অফিসও বন্ধ। কি করব? আজ না হয় থেকেই যাই। বাসায় ফোন দিয়ে বিষয়টা জানিয়ে দিলাম। রাতের অনেকটা সময় গল্প করে কাটিয়ে ঘুমাতে গেছি তখন রাত দুটো। ভোরে উঠে চাচার সাথে নামাজ আদায় শেষে আগের দিনের মতো রওনা হলাম। আবারও ট্রেনের ঝক ঝক শব্দ। তবে, আগের মতো ঘুমাইনি এবার। পত্রিকা কিনে খবর পড়ছিলাম। দেখতে দেখতে ট্রেন এসে স্টেশনে থামল। আমিও নেমে পড়লাম।

বাসায় ফিরছি সকাল ১০ টায়। বাসায় ফিরে দেখি ভাইয়া অফিসে চলে গেছে, স্নেহা আর নিবিড় স্কুলে। বাবা বসে পত্রিকা পড়ছে। আমি আসায় গ্রামের হালচাল জানলেন। মা এসে হাতের ব্যগ নিজের কাছে নিলেন। বিশ্রাম নেওয়ার আসায় নিজের রুমে গিয়ে বসা মাত্রই বাসার ল্যান্ডলাইনে ফোন আসল। মা আমাকে ডেকে ফোনে কথা বলতে বলল। ফোন তুলে শুনতে পেলাম- “আমি সিটি হাসপাতাল থেকে বলছি। আমি কি স্নেহার পরিবারের সাথে কথা বলছি?” জবাবে হ্যাঁ বলা মাত্রই আমাকে হাসপাতালে যেতে বলল। আমি ঘটনা জানতে চাইলে ওপাশ থেকে জবাব আসল আপনি আগে আসুন।

ফোন রাখা মাত্রই বাবা জিজ্ঞেস করল, কিরে সাবির, কি হয়েছে? কে ফোন করেছিল?

আমি শুধু জবাবে বললাম, আব্বু, আমি আসছি। তোমাকে ফোন দিব। মা আর ভাবি আমাকে ডেকেও আর সাড়া পেল না। আমি তো ততক্ষণে বের হয়ে গিয়েছিলাম।

০৪

সিটি হাসপাতালে পৌঁছে দেখি স্নেহার স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শাহিনা ম্যাডাম আর দুজন পুলিশ কন্সটেবল দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন শাহিনা ম্যাডাম আমাকে বলল, তুমি শান্ত হও বাবা। আর একটু শক্ত হতে হবে তোমায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে আগে তো বলুন।

– আমাদের স্নেহা আর নেই…

– কি বলছেন আপনি? কি হয়েছে স্নেহার?

– স্নেহা আজ স্কুলে আসার সময় কারও লালসার শিকার হয়ে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়েছে।

সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে আমি বাকরুদ্ধ। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় চোখ না দিতেই লাল কালিতে যে বড় বক্স শিরোনাম দেখি তার শিকার আজ আমার আদরের বোন স্নেহা? নিজেকে স্থির করলাম। ভেবে নিলাম নিজে শক্ত করে সত্যকে মেনে নিতেই হবে। বাবাকে ফোন দিয়ে বললাম, “বাবা, বাসায় একটা কফিন নিয়ে আসছি। শান্ত থেকো।” বাবা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে শুধু ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন উচ্চারণ করল।

আর কিছু না বলে লাশ নিয়ে বাসায় ফিরতে চাইলে পুলিশ আমাকে তথ্য সরবরাহ করতে বলল। আমি মামলা করতে অপরাগ হয়ে বিনা ময়না তদন্তে স্নেহাকে সাথে নিয়ে বাসায় আসলাম। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতর একটি কফিন আর আমি। আমার হাতে স্নেহার আইডি কার্ড আর ডেথ সার্টিফিকেট। সেখানে শুধুই লেখা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্যই মৃত্যু হয়েছে স্নেহার।

আমি বাসায় ফেরার আগেই স্নেহার স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিষয়টা জানাজানি হলে তাৎক্ষনিক মানববন্ধন করে ওরা স্নেহা হত্যাকারীকে আইনের আওতায় আনতে অনুরোধ করে। স্নেহাকে দেখতে বাসায় আসে স্নেহার ক্লাসের শিক্ষার্থী আর শিক্ষকবৃন্দের অনেকেই। সাথে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীও আসে। বড় ভাই সাকির বিনয়ের সাথেই তাদের বিষয়টি নিয়ে কোন খবর প্রচারে মানা করে চলে যেতে বলল।

কথায় আছে অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর। পরিবারের আদরে মুখ, ছোট্ট নিবিড়ের খেলার সাথি চঞ্চল স্নেহা ফুপ্পি যখন বাকরুদ্ধ হয়ে নিথর দেহে শুয়ে আছে তখন নিবিড়ের মতো বাচ্চাও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কফিনের ভেতর। ওর ফুপ্পি কি আর ওর সাথে খেলা করবে না, গান গাইবে না? নিবিড়ের মনে অনেক প্রশ্ন।

বাবা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলেন স্নেহাকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে। আবার গন্তব্য গ্রামের বাড়ি। অ্যাম্বুলেন্সে স্নেহার কফিন, সাথে আম্মু আর আমি। বাকিরা অন্য গাড়ি করে আসছে। গ্রামে পৌঁছতে না পৌঁছতেই অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল। প্রতিহত করেই এগিয়ে গেলাম আমরা। দাদির কবরের পাশেই স্নেহার কবরের প্রস্তুতি নিল বড় চাচা আর গ্রামের দু একজন যুবক। বাবা নিশ্চুপ হয়ে একটা কেদারায় বসে রইলেন। আম্মু কাঁদছে। ভাবি কেমন জানি হয়ে গেছে। শুধু হাঁটছে। ভাবির সাথেই বেশি সখ্যতা ছিল স্নেহার। স্নেহা ছাড়া ভাবি যেন খুব নিঃসঙ্গ।

০৫

এদিকে কাফন সম্পন্ন হয়েছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মাঝেই মাগরিব বাদ মাঠে স্নেহার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হল। দাদির পাশে স্নেহাকে ঘুম পাড়িয়ে সবাই বাড়ি ফিরল। আমি একটু দেরি করলাম। স্নেহা না কদম ফুল খুব বেশি ভালোবাসত? হ্যাঁ, তাই হয়ত ওর চির নিদ্রায় শয়নের স্থান হয়েছে কদম তলায়। রিমঝিম বৃষ্টি পরছে আর একটু বাতাস বইছে। একটা কদম এসে কবরের মাটির উপর পড়ল। আমি না সরিয়ে রেখে আসলাম। আব্বু-আম্মু, ভাইয়া, ভাবি, নিবিড় বাড়িতে রয়ে গেল। আমি আজ রাতের ট্রেনেই বাসায় ফিরব। তাই, ওদের বাড়ি রেখে চলে আসলাম।

রাত এগারোটায় বাড়ি আসলাম। স্নেহার রুমে গেলাম। পড়ার টেবিলে স্নেহার হাসিমুখের ছবিটা ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে আমার দৃষ্টিতে। বইগুলো এলোমেলো আর আইডি কার্ডটি সেখানেই রেখে গিয়েছিলাম আমি, তার পাশে সকালে আনা একটি কদম রাখলাম।

বদ্ধ ঘরে থাকতে না পেরে ছাদে উঠলাম। বৃষ্টি পড়ছে। আমি ভিজে যাচ্ছি। মনে মনে ভাবছি বৃষ্টি আরো ঝরুক; অনেক ঝরুক। সারারাত ঝরুক। অনন্তকাল ঝরুক। ধুয়ে যাক পৃথিবীর সমস্ত জঞ্জাল; ভেসে যাক সকলের দুঃখ-কষ্ট আর ডুবে একাকার হয়ে যাক সব যাতনা। লোলুপ দৃষ্টি দেওয়া পাপীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। অতঃপর আসুক এক সোনালী-রৌদ্রজ্জ্বল ভোর। সেই ভোরে স্বপ্নের তরী করে ভেসে বেড়াবে স্নেহারা হাসিমুখে।

হঠাৎ দৈব কন্ঠে শুনতে পেলাম- “ভাইয়া, তোকে ধন্যবাদ। তুই তো জানিস, কদম আমার কত্ত প্রিয়! ভালো করেছিস আমায় কদম তলায় রেখে। এখন আর টেবিলে রাখতে হবে নারে…” আমি একটা চিৎকার দিলাম। বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে স্নেহার কথাগুলো শুনুতে পেলাম। রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও একই কথা প্রতিধ্বনিত হয়েই চলছে…।