১০ টাকার পাঠশালা

৩০ বছর আগের কথা। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা তখন তেমন একটা স্কুলে যেত না। অনগ্রসর গ্রামের শিশুদের জন্য শারীরিক প্রতিবন্ধী এক যুবক নিজের ভিটায় গড়ে তোলেন একটি বিদ্যালয়। বর্তমানে ওই বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৫৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বিষ্ণুকাঠিতে সুবোধ চন্দ্র বিশ্বাসের (৬০) এই পাঠশালাকে সবাই ১০ টাকার পাঠশালা নামে ডাকে। কেননা, মাসে মাত্র ১০ টাকা দিয়ে শিশুরা বিদ্যালয়টিতে পড়াশোনা করতে পারে। এটির আনুষ্ঠানিক নাম অবশ্য বিষ্ণুকাঠি গুণসাগর শিশু নিকেতন।

নেছারাবাদ উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বিষ্ণুকাঠি গ্রামে গিয়ে সুবোধ চন্দ্র বিশ্বাসের পাঠশালার কথা জিজ্ঞেস করতেই স্থানীয় লোকজন পথ দেখিয়ে দেয়। গ্রামের সরু মাটির সড়ক পার হয়ে গাছগাছালিতে ঘেরা নিরিবিলি পরিবেশে টিনের দোচালা ঘরের পাঠশালাটি চোখে পড়ে।

সাদামাটা ঘরে পরিপাটি পরিবেশে শিশুরা পড়াশোনা করছে। কেউ শিক্ষকের কাছে গিয়ে পড়া বুঝে নিচ্ছে। আবার কেউ পড়া লিখে শিক্ষককে দেখাচ্ছে। পাঠশালার লাগোয়া একটি গাছের সঙ্গে টানানো রয়েছে কাসার ঘণ্টা। শিশু শিক্ষার্থীরা বেল পিটিয়ে বিদ্যালয় শুরু ও ছুটির জানান দেয়। পাঠদানের ফাঁকে ফাঁকে সুবোধ চন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয়।

সুবোধ বিশ্বাস বললেন, পাঁচ কি ছয় বছর বয়সে হঠাৎ জ্বর হয়ে তাঁর দুই পা অবশ হয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলেন।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাফেরা করতেন। স্কুলে যেতেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর অর্থাভাবে বিদ্যালয়ের পাঠ চুকাতে হয়। কিন্তু দীর্ঘ অলস জীবন তাঁর ভালো লাগছিল না। স্ত্রী অনিমা রানী বিশ্বাসের সঙ্গে পরামর্শ করে ১৯৮৬ সালে বাড়ির আঙিনায় প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যালয়। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া এবং বিদ্যালয়ে না যাওয়া শিশুদের প্রথমে বিনা পয়সায় পাঠদান শুরু করেন তাঁরা। ধীরে ধীরে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের দরিদ্র শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করে তোলা।

সুবোধ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘লক্ষ্য করলাম, আমাদের গ্রামের অনেক শিশু বিদ্যালয়ে যায় না। অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে আমার পাঠশালায় এনে পড়াশোনার ব্যবস্থা করলাম। প্রথমে বিনা পয়সায় পাঠদান করলেও পরে অভিবাবকেরা আমাকে সাধ্যমতো টাকাপয়সা দিতে শুরু করেন। এখানে পড়াশোনা করা শিশুদের গৃহশিক্ষকের কাছে আলাদাভাবে পড়ার দরকার পড়ে না। মাসিক বেতন না দিলে নাম কাটাও হয় না। বিদ্যালয়ে বসেই আমি শিক্ষার্থীদের পড়া বুঝিয়ে দেই।’

সুবোধ চন্দ্র আরও বলেন, এভাবে শিশুদের পড়িয়ে মাসে হাজারখানেক টাকা হাতে আসে। এই বেতন ও বাড়ির ভিটায় সবজি চাষ করে যা উপার্জন হয়, তা দিয়ে কোনো রকমে তিনজনের সংসার চলছে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে বিএ পরীক্ষা দিয়েছে।

বিষ্ণুকাঠি গুণসাগর শিশু নিকেতনের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ইয়াসিন শেখ বলে, ‘স্যার সুন্দর করে পড়া বুঝিয়ে দেন। বিদ্যালয়ে বসেই আমরা পড়া বুঝে নেই। বাড়িতে গিয়ে তেমন একটা পড়তে হয় না। আমরা প্রাইভেটও পড়ি না।’

স্কুলের শিক্ষার্থীদের একজন অভিভাবক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আজকাল প্রাইভেট পড়তে হলে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা শিক্ষককে দিতে হয়। সুবোধ স্যারের পাঠশালায় পড়াশোনার পর আর প্রাইভেট পড়তে হয় না। ওখানে ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২০-২৫ টাকা বেতনে পড়াশোনা করা যায়। যে যা খুশি হয়ে দেন, স্যার তা-ই নেন।’

স্বরূপকাঠি কলেজিয়েট একাডেমির শিক্ষক সুব্রত বিশ্বাস বলেন, ‘আমার শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি সুবোধ স্যারের পাঠশালায়। স্যার পিতৃস্নেহে আমাদের পাঠদান করাতেন। পাঠশালার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনেকেই আজ দেশে ও দেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।’-প্রথম আলো