পেনশন স্কিম বাতিল দাবিতে শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মবিরতিতে
অচল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বজনীন পেনশন ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রত্যাহার দাবিতে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে পড়েছে। কোনো-বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। শিক্ষকদের সর্বাত্মক এ আন্দোলনের সঙ্গে একযোগে কর্মবিরতিতে অংশ নিয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। কর্মসূচির অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি বন্ধ রাখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে ভাঙচুর চালিয়েছে একদল বিক্ষুব্ধ ছাত্র। পেনশন স্কিম বাতিল দাবিতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন এবং কর্মবিরতিসহ নানা কর্মসূচির পর গতকাল সোমবার থেকে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস-পরীক্ষাসহ একাডেমিক বিভিন্ন কার্যক্রম বর্জন করেছেন শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য এ কর্মসূচি শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, শিক্ষকদের দাবি আদায়ের বিষয়ে এখনো সরকারের কোনো পর্যায় থেকে কোনো আশ্বাস পাইনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। প্রত্যয় স্কিম সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের পাশাপাশি সুপারগ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা না নেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা থাকবে বলে জানান তিনি।
অচলাবস্থা ঢাবিতে : সর্বজনীন পেনশন ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রত্যাহারের দাবির কর্মবিরতিতে অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষাসহ দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, গতকাল এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে শিক্ষক সমিতির কয়েক নেতাসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক টিএসসিতে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে অংশ নিলেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদা অনুষ্ঠানে অংশ নেননি। শিক্ষকদের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদও কর্মবিরতিতে রয়েছে।
লাইব্রেরি ভাঙচুর : পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে সর্বাত্মক কর্মবিরতির অংশ হিসেবে গতকাল বন্ধ ছিল কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। লাইব্রেরি বন্ধ পেয়ে গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শিক্ষার্থী ভাঙচুর চালিয়েছেন। জানা যায়, সকাল ৯টার দিকে গেট খোলা হবে এমন আশ্বাস পেয়ে শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করেন। কিন্তু সর্বাত্মক কর্মবিরতির কারণে লাইব্রেরির গেট খোলা হয়নি। এতে শিক্ষার্থীরা প্রবেশপথের সামনে থাকা কিছু ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন এবং গেটে ধাক্কাধাক্কি করেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলেন, আন্দোলনের কারণে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা বন্ধ থাকবে কেন? সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, আমরা বারবার কর্তৃপক্ষকে বলেছি, কঠিন সিদ্ধান্তে যেতে বাধ্য করবেন না। আমাকে প্রশ্ন না করে অর্থ মন্ত্রণালয়কে প্রশ্ন করা উচিত যে, কেন ছাত্ররা লাইব্রেরি ঢুকতে পারছে না, শিক্ষকদের কেন লাইব্রেরি বন্ধ করার মতো আন্দোলনে যেতে হলো? তিনি আরও বলেন, এই আন্দোলন শিক্ষার্থীদের জন্যই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে জরুরি চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী।
কার্যক্রম বন্ধ জবির : সর্বজনীন পেনশন নীতিমালা ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষকরা। একই সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও দফতরে তালা ঝুলিয়ে কর্মবিরতি পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সহযোগী অধ্যাপক শেখ মাশরিক হাসান বলেন, আমরা যৌক্তিক দাবি আদায়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না দাবি আদায় হচ্ছে, আন্দোলন চলবে। তিনি বলেন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা আজ রাস্তায় নেমেছে, যা মোটেও কাম্য ছিল না।
অচল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় : ধারাবাহিক আন্দোলনের পরও সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ বাতিল না করায় গতকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন শুরু করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তাদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সব বিভাগের ও দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বিত আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকা বিভাগগুলোর ক্লাস রুমে ঝুলছে তালা। একাডেমিক ভবনগুলোতে নেই চিরচেনা ব্যস্ততা। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বর, টিএসসি, পরিবহন চত্বর, মুরাদ চত্বর, বটতলা- সব জায়গায় সুনসান নীরবতা। জাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. মোতাহার হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা অচল হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী সরকারি মহলের হঠকারী সিদ্ধান্ত। যতদিন সরকার প্রত্যয় স্কিম বাতিল করবে না ততদিন পর্যন্ত আমাদের এ সর্বাত্মক কর্মবিরতি কর্মসূচি চলবে।
শাটডাউনে রাবি-রুয়েট : সরকারি চাকরিতে সর্বজনীন পেনশন নীতিমালা ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মসূচি পালন চলছে। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ক্লাস-পরীক্ষা ও দাফতরিক কার্যক্রম বর্জনে গতকাল ক্যাম্পাসে শাটডাউন পরিস্থিতি বিরাজ করে। রাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, দাবি আদায়ে শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না দাবি আদায় হচ্ছে, আন্দোলন চলবে। রুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা রাস্তায় নেমেছেন। যা মোটেও কাম্য ছিল না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। অনিবার্য কারণ দেখিয়ে স্নাতক প্রথমবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষা চলছে। অনেক বিভাগে চলতি মাসে পরীক্ষার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বাত্মক কর্মসূচির কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।
বশেমুরকৃবি : প্রত্যয় স্কিম সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সব ক্লাস, পরীক্ষা, সভা, সেমিনার বন্ধ থাকবে বলে বশেমুরকৃবি শিক্ষকরা জানান। বশেমুরকৃবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. মো. অহিদুজ্জামান, অনতিবিলম্বে সরকার এ প্রত্যয় স্কিম বাতিল করে শিক্ষকদের তাদের ক্লাস, পরীক্ষা ও গবেষণা কাজে ফিরিয়ে আনার আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পবিপ্রবি : বৈষম্যমূলক পেনশন প্রজ্ঞাপন বাতিল, সুপার গ্রেড ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে সারা দেশের মতো পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা লাগাতার কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করেছেন। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনের প্রধান ফটকে পবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক জেহাদ পারভেজ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে এ অবস্থান ধর্মঘট শুরু হয়।
হাবিপ্রবি : দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তারাও সর্বাত্মক কর্মসূচি পালন করেছেন। শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে কোনো বিভাগে ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু তবুও কোনো উপায় না পেয়ে আমাদের আন্দোলনে নামতে হচ্ছে। আমাদের দাবি মেনে নিলেই আমরা শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাব।
বেরোবি : শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে স্থবিরতা নেমে এসেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) নিয়মিত শিক্ষা-কার্যক্রমে। একাডেমিক ব্যস্ততার জায়গাগুলোয় বিরাজ করছে নীরবতা। শিক্ষকদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির কারণে শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে আসেনি, অনুষ্ঠিত হয়নি কোনো পরীক্ষাও। অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষ ও পরীক্ষা কক্ষগুলো তালাবদ্ধ ছিল। বেরোবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি বিজন মোহন চাকী বলেন, শিক্ষকদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সব ক্লাস, পরীক্ষা, সমন্বয় সভা, ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
শাবি-সিকৃবি : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) শিক্ষকরা গতকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছেন। শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে গতকাল শাবিতে কোনো ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। শাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রত্যয় পেনশন স্কিম চরম বৈষম্যমূলক। আগের পেনশন স্কিমের সবগুলো সুবিধা থেকে শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
চবি : প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে আটকে গেছে চবির সাত বিভাগের পরীক্ষা। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের উদ্বোধনী ক্লাসও বাতিল করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের এ ক্ষতি অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে পুষিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কার্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আবু নোমান বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পেনশন স্কিম বাতিল না করা পর্যন্ত আমাদের কর্মবিরতি চলবে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন