অটিজম আক্রান্তদের সমাজে জায়গা করে দিতে হবে, বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি

আমি একজন বিশেষ মাকে দেখেছি। যে রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের বিভাগীয় প্রধান। নিজের কর্মস্থল, স্বামী, সংসার সামলিয়েও তাকে বিশেষ একটি শিশুর দায়িত্ব পালন করতে হয়। সংসারের দ্বিতীয় সন্তানটি যখন নানা জটিলতা নিয়ে জন্ম নেয় তখন থেকেই তার বা তার পরিবারের যুদ্ধ শুরু। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটোছুটি। একটি সুন্দর ফুলের মত নিষ্পাপ শিশুকে বাঁচানোর আকুতি। নিজ আত্মজার নিবু নিবু জীবন রক্ষায় রাতের পর রাত জলভরা চোখে জেগে থাকা। আর স্রোতের মত টাকা খরচ তো আছেই। পরে শিশুটির জীবন পেলেও বছর খানেক পর বোঝা গেল সে বিশেষ শিশু। মানে অটিজম। এরপর লোকজনের ফিসফাস। সবাই তাকে আলাদা শিশু হিসেবেই দেখে। একজন মানব সন্তান হিসেবে অনেকেই চিন্তা করে না। এজন্য মা ও বাবার কষ্ট যেন আরো বেড়ে যায়। এরকম ঘটনা অহরহই আমাদের দেশে পরিলক্ষিত হয়। শুধু কি বাংলাদেশে? বিশ্বের সব দেশেই এই ধরনের সমস্যা প্রকট। উন্নত দেশে এর চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এইসব মানুষ বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন। মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গিও বদলেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও সরকারের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি যৌথভাবে অটিজম নিয়ে কাজ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম নিয়ে কাজ করার পর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনেক বদলেছে। কিন্তু গবেষণা বলছে, অটিস্টিক শিশুদের মায়েরা প্রায় অর্ধেক মানসিক রোগী। প্রধান গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, অটিজম মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। এই সমস্যার কারণে শিশু অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ ও সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। এরা একই কাজ বা আচরণ বারবার করে। ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের ৭ শতাংশ অটিস্টিক। এক-তৃতীয়াংশ অটিস্টিক শিশুর মায়েরা পরিবার-প্রতিবেশীর কাছ থেকে নেতিবাচক আচরণ পান।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগলেও অনেক মা চিকিৎসকের কাছে যান না, যেতে পারেন না। কিন্তু আমি লেখাটি শুরু করেছিলাম যাদের কথা দিয়ে তারা বিদেশেও গিয়েছিলেন। তার ছেলের অবস্থার উন্নতি হলেও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। আর উঠারও কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই মায়ের যত্ম ছাড়াও তার জন্য লোক রেখে দেখাশোনার কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে সবার অবস্থাতো ওই ধনী পরিবারের মত নয়।

এই যে আমাদের সমাজে এই বিশাল সংখ্যক অটিস্টিক রোগী- এদের ভব্যিষত কি? অনেক পরিবার আছে যারা আর শত চেষ্টা করেও এই ভার বহন করতে পারছেন না। তাই অনেক নিম্মবিত্ত পরিবার তাদেরকে ভিক্ষা বৃত্তির কাজে লাগায়। কেউ কেউ অবহেলা অনাদরে ঘরের কোণে পড়ে থাকে। কেউ কেউ বিছানা নষ্ট করলেও ধুয়ে পরিস্কার করার মত কেউ থাকে না। গবেষণা মতে, ৪১ শতাংশ মা একাই অটিস্টিক শিশুর দেখাশোনা করেন। অটিজম শিশু জন্ম দেওয়ার কারণে অনেক মাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। ভেঙ্গেছে সংসারও। অটিজম শিশুর জন্য মাকে দোষ দেওয়া হয়। কিন্তু মা মারা গেলে কিংবা অক্ষম হলে তাকে আর দেখার কেউ থাকে না। এই জন্য এসব বিশেষ শিশু বা ব্যক্তিদের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

বাংলাদেশে অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিসঅ্যাবিলিটি নিয়ে যেটুকু কাজ হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে ও নির্দেশনায়। ২০১০ সালে CNAC (Centre for Neurodevelopment and autism in Children) কর্মসূচি হিসেবে সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয় প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রশাসনের অক্লান্ত পরিশ্রমে, যার উদ্বোধন করেন শিশু প্রেমিক, শিশু বশীকরণের অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারিণী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন এর হাল ধরেছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

অটিস্টিক শিশুসহ বিদ্যালয় গমনোপযোগী সকল শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তকরণ বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার এবং এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম লক্ষ্য। সরকারের এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে অটিস্টিক শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি ও তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যাশনাল অটিজম এন্ড নিউরো ডিসঅর্ডার এডভাইজরি কমিটি এবং গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ এর চেয়ারম্যান সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এর নেতৃত্বাধীন Global Autism Public Health Bangladesh (GAPH) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

আশার কথা হলো বঙ্গবন্ধুর এই নাতনি এই রোগের হাল ধরার পর থেকে বাংলাদেশের চিত্র বদলে যেতে শুরু করেছে। আর এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী অটিজম দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ব্যাপক সচেতনতামূলক কাজ করছে।

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর/ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হতে নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে সরকারের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। যেমন-অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা ও সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় ২০১৩ সালে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩; প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এবং বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন-২০১৮” প্রনয়ণ করা হয়েছে। এই আইনটির ফলে দেশের বিদ্যমান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কিংবা দুর্ঘটনার ফলে পঙ্গুত্ববরণকারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি পুর্নবাসন প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে।

সরকার অটিজমে আক্রান্তদের কল্যাণে বদ্ধপরিকর তাই রাজধানীতে অটিজম সংক্রান্ত অনেকগুলো চিকিৎসা সহায়তাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইন্সটিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিসঅর্ডার এন্ড অটিজম (IPNA), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, চাইল্ড গাইডেন্স ক্লিনিক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শিশু বিকাশ কেন্দ্র, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, প্রয়াস বিশেষায়িত স্কুল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর শিশুরোগ/মনোরোগবিদ্যা বিভাগ সে প্রচেষ্টারই প্রতিফলন। তাছাড়া সারাদেশে জেলা সদর হাসপাতাল/উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স; সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষায়িত স্কুল, প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন থেকে এ সংক্রান্ত সেবা দেওয়া হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সারাদেশে ১০৩টি সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। টঙ্গীস্থ ইআরসিপিএইচ কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় স্থাপিত মৈত্রী শিল্প কেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্লাস্টিকসামগ্রী যেমন: বালতি, জগ, মগ, বদনা, গ্লাস, হ্যাঙ্গার উৎপাদন করা হয়।

সরকারের পাশাপাশি সূচনা ফাউন্ডেশন, প্রয়াস,সোয়াক, সিডিডি, পিএফডিএ, স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন, সোসাইটি ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব দ্য ইন্টেলেকচুয়ালি ডিজএ্যাবল (সুইড) বাংলাদেশ, সীড ট্রাস্ট, অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, বিউটিফুল মাইন্ড, নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন, এফএআরইসহ আরও অনেক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদার, সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি, অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজিএবলিটিস এর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের বিকাশে আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষিতে অটিজম সমস্যাগ্রস্ত শিশু/ব্যক্তিদের সনাক্তকরণ, স্পিচ এ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি, অপটোমেট্রি, সাইকো সোস্যাল কাউন্সেলিং, অকুপেশনাল থেরাপি অভিভাবকদের কাউন্সেলিং, ফিজিওথেরাপি, অডিওমেট্রি গ্রুপ থেরাপির মাধ্যমে খেলাধুলা ও প্রশিক্ষণ বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। আর দরকার প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয়ে সুনিদির্ষ্ট কার্যক্রম। অন্যদিকে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ প্রাথমিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবাও সহায়ক উপকরণ তৈরি ও সেবা প্রদান এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা কার্যক্রম বাড়াতে হবে। অটিজম আক্রান্তদেরকে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখে তাদের কল্যাণে কাজ করতে হবে। তাদেরকে সফল, ক্ষমতায়িত ও কর্মক্ষম ব্যক্তিতে পরিণত করতে আমাদেরকে সমন্বিত ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে হবে। অটিজম আক্রান্তদের সমাজে জায়গা করে দিতে হবে, যাতে তারা তাদের অবদান রাখতে পারে। অন্যথায় সমাজে বড়ো ধরনের বিভেদ তৈরি হবে। আর সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলের মত সংবেদনশীল ব্যক্তিত্ব যখন এর হাল ধরছেন তখন এখানে আমাদের সফলতা নিশ্চিত এ আশা আমরা করতেই পারি।
পিআইডি ফিচার

লেখক:
সিরাজুজ্জামান
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক