অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি হয় না পুলিশের

গুরুতর অপরাধেও দেয়া হয় লঘু দণ্ড। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধ করেও শাস্তি পেতে হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিভাগীয় শাস্তির নামে যেসব শাস্তি দেয়া হয়, বিশেষজ্ঞদের মতে তা আসলে কোনো ধরনের শাস্তিই নয়। এমনটাই ঘটছে পুলিশ সদস্যদের অপরাধের ক্ষেত্রে। এছাড়া পুলিশের কোনো সদস্য অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে বিচারের বিধান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কার্যকর হচ্ছে না।

অনেক ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধের বিচারও করা হয় বিভাগীয় আইনে। এক্ষেত্রে অভিযুক্তদের ‘বিভাগীয় শাস্তির আওতায়’ আনার কথা বলে আড়াল করার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত এবং বিচারও করে পুলিশ। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত বিশ্বে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে আলাদা কমিশন করে তার বিচার করা হয়। বাংলাদেশেও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে দুর্নীতি দমন কমিশন বা নির্বাচন কমিশনের মতো স্বাধীন কমিশন গঠনের ব্যাপারে মত দিয়েছেন তারা। এতে অপরাধ অনেকাংশে কমবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শাস্তি পাওয়া পুলিশের সংখ্যা ১০ হাজার ৪২১ জন। ২০১৬ সালে ১৩ হাজার ৫৮৬, ২০১৫ সালে ১১ হাজার ১৬৭, ২০১৪ সালে ১৫ হাজার ২৯৭, ২০১৩ সালে ১৪ হাজার ৬০ এবং ২০১২ সালে ১২ হাজার ৯৯২ জন পুলিশ সদস্য অপরাধ করে শাস্তি পেয়েছেন। তবে শাস্তি পাওয়া অধিকাংশ পুলিশ সদস্য উচ্চ আদালতে আপিল করে চাকরিতে ফিরে আসছেন বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি-১৮৬১) অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির বিধান রয়েছে একটি লঘু, অন্যটি গুরুদণ্ড। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিতকরণ ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ, বিভাগীয় মামলা করা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত করা হয়। গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি ছোট ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইন্স বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদণ্ড দেয়া হয়।

২০১২ থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লঘুদণ্ড পেয়েছেন ৭৩ হাজার ৩৩৩ জন পুলিশ সদস্য। একই সময়ে গুরুদণ্ড পেয়েছেন ৩ হাজার ৯৯১ জন। এর মধ্যে চাকরিচ্যুতি বা বরখাস্ত হয়েছে ৫০৬ জনকে। বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে ৩৬ জনকে। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শাস্তি পাওয়া এসব পুলিশ সদস্যের বেশিরভাগই আপিল করে চাকরিতে ফিরে গেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজের পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবিতে শাহবাগে আন্দোলনের সময় ২০১৭ সালের ২০ জুলাই পুলিশের টিয়ার শেলের আঘাতে চোখ হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রাথমিক অবস্থায় রমনা জোনের এসি, শাহবাগ থানার ওসি অপারেশন, ওসি তদন্ত এবং দুই কনস্টেবলকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে দুই কনস্টেবলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বাকিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু তারা এখনও বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন।

২০১৬ সালে সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ ঘটনার প্রধান আসামি কামরুলকে বিদেশে পালাতে সহায়তা এবং রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমানকে থানা থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগে জালালাবাদ থানার এসআই আমিনুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর আর কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। জানা গেছে, ওই পুলিশ সদস্যকে ‘শাস্তিস্বরূপ’ সিলেট রেঞ্জ থেকে অন্য রেঞ্জে বদলি করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ১২ জুলাই রাতে ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজনকে রাজধানীর ধানমণ্ডির শংকরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে মিরপুর থানায় নির্যাতনের পর হত্যা করে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় ১৭ জুলাই মিরপুর থানায় মামলা করা হয়। আসামি করা হয় ওই থানার এসআই জাহিদুল ইসলাম, এএসআই রাজকুমার, কনস্টেবল আনোয়ার হোসেন, রাশিদুলসহ আটজনকে। এ ঘটনায় এসআই জাহিদকে গ্রেফতার করা হয়। একই সঙ্গে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশের ওপর। ঘটনার বিভাগীয় তদন্তও করে পুলিশ। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্তদের সাময়িক বরখাস্ত ছাড়া আর কোনো শাস্তিই দেয়া হয়নি।

পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে নারী নিপীড়নের ঘটনায় দায়িত্বে গুরুতর অবহেলার অভিযোগ ওঠে শাহবাগ থানার এসআই আশরাফুল ইসলাম, পরিদর্শক (তদন্ত) সায়েদুল ইসলাম ভূঁইয়া ও পুলিশের সহকারী কমিশনার সাবেরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ঘটনার ৫ দিন পর এসআই আশরাফুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই সঙ্গে তৎকালীন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ইব্রাহীম ফাতেমিকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে কমিটি ডিএমপি কমিশনারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযুক্ত তিন পুলিশ কর্মকর্তাই এখন বহাল তবিয়তে।

বর্ষবরণের দিন ওই নারী নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন ছাত্র ইউনিয়নের এক নেত্রী। এ ঘটনার দু’দিন পর পুলিশের নায়েক আনিসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে আর কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ডিআইজি মিজানুর রহমানের অপকর্ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে একজন অতিরিক্ত আইজিকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। একই সঙ্গে ওই কর্মকর্তাকে কর্মস্থল থেকে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। প্রভাবশালী এ পুলিশ কর্মকর্তাও শাস্তি পাবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এভাবেই সিংহভাগ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলেও প্রাথমিক শাস্তি কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার কিংবা সাময়িক বরখাস্ত পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে ‘বিভাগীয় ব্যবস্থা’। প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্তের নামে পুলিশের যে শাস্তি দেয়া হয়, তা কোনো শাস্তির পর্যায়েই পড়ে না বলে মন্তব্য করেছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জহিরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, কোনো বড় ঘটনা ঘটলে এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই বদলি, প্রত্যাহার, ক্লোজ বা সাময়িক বরখাস্তের শাস্তি দেয়া হয়। এসব শাস্তিতে সাময়িকভাবে কাজের ‘বিঘ্ন ঘটা’ ছাড়া কোনো প্রভাবই পড়ে না পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে বড় শাস্তি পেতে হয় না অভিযুক্তকে। ফলে প্রচলিত এই শাস্তি পুলিশের অপরাধ কমাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অপরাধ পুলিশই তদন্ত করছে। আবার বিচার প্রক্রিয়ায়ও অংশগ্রহণ করছে। ড. জহিরুল বলেন, পুলিশের দুর্নীতি, ঘুষ, অন্যায়ের ক্ষেত্রে যদি নিজ বিভাগ দায়িত্ব পালন করে তাহলে সঠিক তদন্ত, চার্জশিট বা সঠিক ফলাফল আসবে না।

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, সাধারণত তদন্ত এভাবেই হয়। এখানে আস্থার সংকটও আছে। আস্থা ও ভরসার জায়গায় আমরা একটু সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। এজন্য এ প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর খুব কমই শাস্তি থেকে বাঁচতে পারছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিকীকরণের একটি অপচেষ্টা চলে। নূর মোহাম্মদ আরও বলেন, পুলিশকে আরও শক্তিশালী এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আলাদা কমিশন প্রয়োজন যেটি ‘পুলিশ সংস্কার কমিশনে’ ছিল। বিষয়গুলো নির্ভর করে সরকারের ওপর। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, চাকরি করতে গিয়ে যদি কাউকে মারধর করে, টাকা-পয়সা নিয়ে নেয় বা সম্পতি দখল করে তাহলে এগুলো ফৌজদারি অপরাধ।

এক্ষেত্রে সবার জন্য যে আইন আছে পুলিশের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। কিন্তু পুলিশের এসব অপরাধ প্রচলিত আইনে কেন শাস্তির আওতায় আসছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই ফৌজদারি আইনের আওতায় আসবে, না আসাটা অনভিপ্রেত। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত পুলিশই করছে জানিয়ে সরকারের সাবেক এ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, এটা শুধু পুলিশে নয়, দুদকের কোনো সদস্য অপরাধ করলেও তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক।

প্রকৃত পক্ষে আমাদের একটি সিস্টেমে যাওয়া উচিত যেখানে কেউ অপরাধ করলে থার্ডপার্টি তদন্ত করবে। এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড শাখার পরিচালক অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল হক বলেন, পুলিশের কোনো সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে অথবা আমাদের দৃষ্টিতে এলে তার গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে।

এছাড়া পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে আইজিপি কমপ্লেইন সেল অনলাইন সার্ভিস চালু আছে। সেখানে অভিযোগ এলেও তা আমলে নেয়া হয়। তিনি বলেন, যদি কোনো পুলিশ সদস্য ফৌজদারি অপরাধ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। ফৌজদারি অপরাধে পুলিশের বিচার তুলনামূলক কম হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, সংখ্যা একেবারই কম নয়। সূত্র : যুগান্তর