‘আমি মেয়ে হয়ে আরেকটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি’
পাঠকের প্রশ্ন : আপু, সালাম জানবেন। আমি যা লিখবো আমি জানিনা এমন কথা আপনাকে আগে কেউ লিখেছে কিনা। আপু, আমি মেয়ে হয়ে আরেকটি মেয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। আপনি হয়তো জেনে খুব ঘৃণা করবেন, রাগ করবেন। কিন্তু এইটা সত্যি। আমি এমন একজন মানুষের প্রেমে পড়ে গিয়েছি যিনি বয়সে আমার অনেক বড়। উনি আমাদের কলেজে পড়ান।
ছোটবেলা থেকেই আমি একা একা বড় হয়েছি। আমার মা-বাবা দুজনেই চাকরি করেন, মায়ের পোস্টিং ঢাকার বাইরে। আমি, আব্বু ও আমার ছোট ভাই ঢাকায় থাকি। আমার কেন যেন মনে হয় আমার আম্মুর সাথে আব্বুর সম্পর্ক ভালো না। কারণ আম্মু ঢাকায় আসে খুব কম, আমরাও সিলেট যাই খুব কম। অনেক সময় ঈদের দিনেও আব্বু আমাদের দুই ভাই-বোনকে নিয়ে ঈদ করে। আব্বু- আম্মু ঢাকায় আমাদের ফুপু থাকেন। আম্মুর সব দায়িত্ব ফুপু পালন করেন আমাদের প্রতি। ঢাকায় এলে আম্মু আমার সাথে ঘুমায়, আব্বুর সাথে আম্মুর কথাবার্তাও কেমন জানি লাগে। আম্মুর সাথে আমার বেশি কথা হয় না, আব্বুকে খুব ভয় পাই। ফুপুকে একবার এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু উনি কোন জবাব দেয় নাই।
আমি যাকে ভালবাসি আপু, উনি কলেজে আমাদের বোটানি পড়ান। উনি আমাকে অনেক আদর করেন। প্রথম দিন থেকেই করেন। আমি উনার বাসায় প্রাইভেট পড়তে গেলে অন্যদের পড়ানো শেষেও আমাকে পড়ান। প্রত্যেকদিনই নাস্তা বানিয়ে খাওয়ান। আমি কেমন আছি, বাসায় কী অবস্থা, আমার কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করেন। ম্যামের একটা ছেলে আছে ৬ বছরের, উনার স্বামী বাংলাদেশের বাইরে থাকে। ম্যামের সাথে আমি কয়েকবার বেড়াতেও গিয়েছি গোপনে। ম্যাম আমাকে বলেছেন যে উনি আমাকে খুব পছন্দ করেন। ম্যাম বলেছেন উনার স্বামীর সাথে উনি সুখী না, স্বামী উনার কোন খোঁজ রাখেন না। ম্যাম নিজের জীবনের অনেক কথা বলে আমার কাছে কান্না করেছেন, আমিও আমার জীবনের সব কথা তাঁকে বলেছি। ম্যাম বলেছেন যে উনি আমাকে ভালোবাসেন। স্বামীর সাথে নয়, উনি আমার সাথেই নিজের জীবন কাটাতে চান। উনি আমাকে দিয়ে এই ওয়াদাও করিয়েছেন যে আমি আজীবন তাঁর পাশে থাকবো। আমি জানি না আপু কেন করেছি, কিন্তু সেই ওয়াদা আমি উনার পীড়াপীড়িতে করে ফেলেছি।
দুজন মেয়ের মাঝে কি ভালোবাসা হয়, আপু? এটা কি সম্ভব? আমি জানি না।
কিন্তু দিন দিন ম্যামের প্রতি আমি আরও অনেক বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি। উনি যেভাবে কথা বলেন আমার সাথে, উনি যেভাবে আমাকে সাপোর্ট করেন, আমার সব কথা শোনেন সবই আমার খুব ভালো লাগে। আমার ভয় হয়, আমি উনার কথা না শুনলে উনি হয়তো আমাকে আর ভালো চোখে দেখবেন না।
আপু, আমি কি অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছি? নাহলে নিজে মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়েকে কেন ভালো লাগবে আমার? আমি কি লেসবিয়ান হয়ে গেছি? আমার বান্ধবীদের সবারই ছেলেদের সাথে রিলেশন আছে, আমার জীবনে কিন্তু কেউ নেই আপু। এমনকি কারো সাথে ফেসবুকে বা ফোনেও কথা হয় না আমার। শুধু ম্যামের কাছে গেলে কী যে হয়ে যায়, উনি যা বলেন সবই করতে ইচ্ছা করে। উনার চোখে পানি দেখলে আমিও কষ্ট পাই। এটা কি ভালোবাসা আপু? এইটা কি প্রেম?
আমার নিজেকে মাঝে মাঝে খুব ঘেন্না লাগে। মনে হয় আমি কেন নরমাল না। আমার বাসায় কেউ এই ব্যাপারটা জানতে পারলে কী হবে আমি ভাবতেও পারি না। মরে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না আমার। এমন কেউ নেই যাকে আমি এই কথা বলতে পারি। আপনাকে বললাম, আপু। প্লিজ সমাধান দিন।
পরামর্শ: মেয়ে, আমি এখন যা বলবো সেটা শুনতে কি তোমার ভালো লাগবে? বা তুমি কি আমার কথাগুলো একটু ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করার চেষ্টা করবে? যদি মনে করো যে করবে, তাহলে পরের কথাগুলো একটু মন দিয়ে পড়ে দেখো…
আমি বিস্তারিত জানিনা ঠিকই, কিন্তু চিঠি পড়ে আমি যা বুঝতে পারছি সেটা হচ্ছে তোমার সমস্যার ভিত্তি লুকিয়ে আছে তোমার পারিবারিক সমস্যার মাঝেই। তোমার মাতা-পিতার মাঝে খারাপ সম্পর্ক, স্বাভাবিক পারিবারিক সম্পর্কের অভাব, নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, ইন্ট্রোভারট মনোভাব ইত্যাদি সবকিছুই তোমার ওপরে একটা ছাপ ফেলেছে। হয়তো সেই কারণেই খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপারকেই অস্বাভাবিক হিসাবে দেখছো তুমি বা ম্যামের প্রভাবে দেখতে বাধ্য হচ্ছো। হয়তো ম্যাম জেনে বুঝে প্ল্যান করেই তোমাকে প্রভাবিত করছেন।
হ্যাঁ, আজকাল সমকামিতা সমাজে একটা ইস্যু বটে। ব্যাপারটি অহরহ দেখা যাচ্ছে, পজেটিভ-নেগেটিভ অনেক ধরণের আলোচনাই হচ্ছে। কিন্তু আপু, আমার মনে হয় না তুমি সমকামি বা সমপ্রেমী। বরং আমার মনে হয় ম্যামের প্রতি তোমার আকর্ষণের কারণটা লুকিয়ে আছে তোমার ব্রোকেন ফ্যামিলি হিস্ট্রির মাঝে। ছোটবেলা থেকেই নিজের মাকে তুমি কাছে পাও নি, পরিবারটি অসম্পূর্ণ ছিল তোমাদের। এটা খুবই স্বাভাবিক যে বুকের মাঝে আদর ও স্নেহ পাবার আকাঙ্ক্ষা পুষে নিয়েই তুমি বড় হয়েছো। আর বিশেষ করে তোমাদের এই টিন এজ বয়সে সেই বাড়তি কেয়ারটুকুন আরও অনেক বেশি জরুরী। এই বয়সটাই এমন, যে-ই আমাদেরকে একটু বাড়তি মনযোগ দেয়, আমরা তাঁদের প্রতিই দুর্বল হয়ে পড়ি। এবং আমি মনে করি ম্যামের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।
শিক্ষক হিসাবে নিশ্চয়ই ম্যামকে তুমি শ্রদ্ধা করতে, পছন্দ করতে। সেই পছন্দের মানুষটাই যখন তোমার কেয়ার করতে শুরু করলো, যত্ন নিতে শুরু করলো, তোমার সব কথা মন দিয়ে শুনতে শুরু করলো, তোমাকে কোম্পানি দিতে শুরু করলো… তুমিও তাঁকে ভালোবেসে ফেললে। হ্যাঁ, ভালোবেসে ফেললে। কিন্তু কি জানো, এই সমলিঙ্গের ভালোবাসা মানেই সমকামিতা/সমপ্রেম নয়। ভালোবাসা মানেই প্রেম নয়। আমরা তো নিজের মা, বান্ধবী, বড় বোন, খালা, চাচী, ফুপু, শিক্ষিকা কত মানুষকেই সম্মান করি ও ভালবাসি। তাই বলে সব ভালোবাসাই কি সমকামিতা বলো? না, সব ভালোবাসা প্রেম নয়। তুমি ম্যামকে ভালবাসো, পছন্দ করো মানেই এই নয় যে তুমি তাঁর প্রেমে পড়েছো। বরং আমার চিঠি পড়ে আমার এটাই মনে হচ্ছে যে প্রেম-ভালোবাসা এইসব টার্ম নিয়ে তোমার ধারণা পরিষ্কার নয়। অবশ্য তোমার বয়সটাও খুবই কম এসব বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার হবার জন্য। আমার পরামর্শ থাকবে এই যে নিজের সেক্সুয়ালিটি সম্পর্কে কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিও না। ম্যাম বললেন বলেই তুমি নিজেকে সমকামি মনে করা শুরু করলে , বিষয়টা এমন না হোক।
আর ম্যামের সাথে তোমার সম্পর্কের যে বিষয়টা…
দেখো, আমি মনে করি তাঁর সাথে সম্পর্কটি তোমার সব দিক দিয়েই অন্যায়। তুমি যদি সমপ্রেমী না হয়ে থাকো তাহলে তো এটা নিয়ে কথা বলার দরকারই নেই। আর যদি হয়েও থাকো, তবুও তাঁর সাথে সম্পর্কটি নৈতিক নয়। কারণ তাঁর স্বামী ও সংসার আছে। তাঁর স্বামী কাছে থাকেন না বা তাঁদের সম্পর্ক ভালো নয়, এই সমস্যাটি তাঁর নিজেকেই সমাধান করতে হবে। তুমি চাইলেও তাঁর এই সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। বরং তোমার উপস্থিতি পুরো ব্যাপারটিকে আরও ঘোলাটে করে তুলবে। ম্যামের সন্তানের জীবনেও জটিলতা তৈরি করবে। ম্যামকে যদি ভালোবেসেই থাকো, তাহলে তাঁর ভালো চিন্তা করেই তাঁর জীবন থেকে সরে যাওয়াটা উচিত। ম্যাম একটি অন্যায় করতে চাইছেন, বিষয়টিকে প্রশ্রয় দেয়া এই মুহূর্তে তোমার উচিত হবে না।
একটি জিনিস মনে রাখবে আপু, কিছু ওয়াদা সকলের ভালোর জন্য ভাঙ্গাই যায়। তুমি যে সারাজীবন ম্যামের পাশে থাকার ওয়াদা করেছো, এটা তেমনই একটা ওয়াদা। কিন্তু হ্যাঁ, যেহেতু তিনি তোমাদের কলেজে পড়ান, তাঁর কাছ থেকে সরে আসার কাজটি তোমাকে করতে হবে খুবই সাবধানে। অহেতুক সম্পর্কে জটিলতা তৈরি হলে তোমার পরিক্ষার ফলেও সেটার প্রভাব পড়তে হবে। তাই আমি তোমাকে কয়েকটি পরামর্শ দিচ্ছি তোমার করণীয় সম্পর্কে-
-ম্যামের সাথে তোমার সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করবে না।
-ম্যামের সাথে অতিরিক্ত বাড়তি সময় কাটানোর সুযোগ তৈরি করবে না। খুব ভালো হয় যদি প্রাইভেট পড়া বন্ধ করে দিতে পারো। বলবে যে তোমার বাসা থেকে মানা করে দিয়েছে। যদি সেটা বন্ধ করা সম্ভব না হয়, তাহলেও পড়া শেষ মাত্র অন্যদের সাথে বের হয়ে যাবে।
-ম্যাম যদি তোমাকে অন্য কোথাও ডাকেন বা বেড়াতে নিয়ে যেতে চান তাহলে কোনভাবেই যাবে না।
-তাঁর সাথে ফোনে বা ফেসবুকে কথা বলা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনবে।
-কোন অবস্থাতেই নিজের কোন রকমের ছবি তাঁকে দেবে না। কিংবা তাঁর যৌন আহবানে সাড়া দেবে না।
শেষ কথা এই যে, তুমি এখনও প্রাপ্তবয়স্ক নও। টিন এজ বয়সে মানুষের কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়ার ব্যাপারটা খুবই বেশি ঘটে থাকে। নিজেকে জানতে ও বুঝতে শিখো, হুট করে ঝোঁকের মাথায় জীবনের সিদ্ধান্ত নিও না। এখনও জীবনের সিদ্ধান্ত নেবার বয়স তোমার হয়নি, আপু। অনেক লম্বা একটা জীবন পড়ে আছে সামনে। আস্তে আস্তে নিজেকে আবিষ্কার করবে ও জানবে-বুঝবে। ততদিন একটি ভুল সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে জীবনটা জটিল করে ফেলো না।
শুভকামনা তোমার জন্য।
পরামর্শ দিয়েছেন-
রুমানা বৈশাখী
কথা সাহিত্যিক ও রিলেশনশিপ কাউন্সিলার
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন