‘আয়নাঘরে’ সারাক্ষণ বন্দিদের চিৎকার শোনা যেতো: বিবিসিকে মাইকেল চাকমা

এখন ঢাকার মুক্ত আলো-বাতাসে হেঁটে বেড়াচ্ছেন এক ব্যক্তি। যাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে ‘আয়নাঘর’ নামক গোপন একটি কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি আলোর মুখ দেখেননি। অন্ধকার ঘরের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে এখন আলোর দিকে তাকাতেও তার কষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘ এই সময় তিনি অতিবাহিত করেছেন শুধু বৈদ্যুতিক পাখার শোঁ শোঁ শব্দ আর নির্যাতনের চিৎকার শুনে। হঠাৎ একদিন খোলা সড়কে মুক্ত বাতাসে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন তিনি। তখন তার সহোদর বোনের মোবাইল নাম্বারও স্মরণ করতে পারছিলেন না তিনি।

সরকারের সমালোচনা করায় ওই ব্যক্তিকে জোরপূর্বক গুম করেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনা ক্ষমতা হারানোর পর তাকে ‘আয়নাঘর’ নামক ওই বন্দিশালা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এই বর্ণনা পড়ার পর পাঠক অবশ্যই বুঝতে পারছেন আমরা ২০১৯ সালে গুম হওয়া মাইকেল চাকমার কথা বলছি।

মাইকেল চাকমাকে গুম করার পর যখন খোঁজাখুজি করেও তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না তখন তার পরিবারের লোকজন ধরেই নিয়েছিল তিনি আর বেঁচে নেই। তাই তারা দুই বছর আগে মাইকেলের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানও সম্পন্ন করেছিলেন।

২০১৯ সালের এপ্রিলে একদল লোক মাইকেল চাকমাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। এরপর টানা পাঁচ বছর তার কোনো খবরই পায়নি তার পরিবার। তারা ভেবে নিয়েছিল মাইকেল চাকমা আর বেঁচে নেই। যাইহোক অবশেষে হাসিনার পতনের পর তিনি আবার মুক্ত আলো-বাতাসে ফিরে এসেছেন।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের পক্ষে কথা বলে আসছেন মাইকেল চাকমা। সেখানকার অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। যারা বাংলাদেশের মোট ১৭ কোটি জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে মাইকেল পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক উপস্থিতি লাঘবের জন্য কাজ করতেন। অপহরণের একদিন পর তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং তৎকালীন সরকারের অনুগত ডিজিএফআইয়ের কয়েকজন সদস্য তাকে তাদের অধিকৃত একটি গোপন কারাগারে বন্দি করেছিলেন।

এ বিষয়ে মাইকেল বলেছেন, তাকে যেখানে রাখা হয় সেটি ছিল জানালাবিহীন একটি ছোট কক্ষ। সেখানে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ ছিল না। কক্ষটিতে ছিল ঘড়ঘড় শব্দ করা দুটি বৈদ্যুতিক পাখা। সেখানে প্রবেশের পর মাইকেল চাকমা দিন রাতের হিসাব ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আমার সেখানে কাউকে দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু আমি সারাক্ষণ শুধু বন্দিদের আর্তনাদের চিৎকার শুনতে পেতাম। সেই চিৎকার ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। সেখানে তার মতো অনেককে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হতো বলে অভিযোগ করেছেন মাইকেল। তিনি বলেছেন, তারা আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। সেসময় তারা আমাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করার হুমকি দিতেন। তারা আমাকে প্রশ্ন করেছিল আমি কেনো হাসিনার সমালোচনা করেছি?

মাইকেল চাকমার বোন বলেছেন, আমার ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমরা তার খোঁজে এক থানা থেকে অন্য থানায় ঘুরেছি। পুলিশের কাছে গিয়েছি। কিন্তু তারা আমাদের বলেছে, তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো খবর নেই। নিখোঁজ হওয়ার পর যতই দিন গড়িয়েছে আমরা ততই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। ভাইয়ের চিন্তায় আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

মাইকেলের বোন আরও বলেন, আমার পুরো পরিবারের মানসিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল। আমার ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্য ছিল খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার। পুত্রের শোকে ২০২০ সালে আমাদের বাবা মারা যান। এর ১৮ মাস পর আমরা মাইকেলের আশা একদম ছেড়ে দেই এবং বৌদ্ধ ধর্মমতে আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন করি। আমরা তখন তার জন্য অনেক কেঁদেছিলাম।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, ২০০৯ সালের পর থেকে কমপক্ষে ৬০০ মানুষকে জোরপূর্বক গুম করেছে শেখ হাসিনার সরকার। এ বিষয় নিয়ে মুখ খোলাও তখন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কেননা শেখ হাসিনা ভিন্ন মত দমনে বেশ কঠোর ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে সমালোচনাকে তিনি প্রায়ই স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন। যদিওবা কেউ কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন কিন্তু তা কখনই স্বীকার করেননি তিনি। গুম হওয়া বেশ কয়েকজনকে অবশ্য বিভিন্ন সময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সংখ্যা খুবই কম। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে গুম হওয়ার পর মুক্তি পাওয়া মানুষের সংখ্যা ১০০ জনের কাছাকাছি ছিল।

২০২২ সালে বাংলাদেশি বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা দ্বারা পরিচালিত গোপন কারাগারের একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে। সে খবর দেখে মাইকেল চাকমার বোন পুনরায় আশাবাদী হন যে তার ভাই হয়তো এখনও বেঁচে আছেন। ওই বছরের মে মাসে নেত্র নিউজ নামের একটি গণমাধ্যমে প্রথম ওই বন্দিশালার কথা তুলে ধরা হয়। গণমাধ্যমটির প্রতিবেদনে প্রকাশিত খবরে তারা দাবি করেন, ‘আয়নাঘর’ নামক ওই বন্দিশালা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কোথাও অবস্থিত। সেসময় ওই প্রতিবেদনে বন্দিশালার ভেতরের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছিল মাইকেল চাকমার বর্ণনার সঙ্গে তার মিল রয়েছে। যেমন তখন বলা হয়েছিল, বন্দিশালার কক্ষগুলোতে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই।