আলু পেঁয়াজ ডিমের সরকার নির্ধারিত মূল্য কাগজ-কলমে, অকার্যকর বাজারে
বেশি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকারি আদেশ উপেক্ষা করেই চলেছে। ফলে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর হচ্ছে না। সাত দিন পার হলেও তদারকি সংস্থা বাজারে নির্ধারিত দাম নিশ্চিত করতে পারছে না।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দুই দফায় ১০ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এরপরও বাড়তি দরেই বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ কিনতে ক্রেতার এখনো কেজিপ্রতি গুনতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা।
পাশাপাশি সিন্ডিকেট ভাঙতে না পেরে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আলু আমদানির সুপারিশের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। মূল্য নির্ধারণের সরকারি সিদ্ধান্তে ক্রেতার কোনো লাভ হচ্ছে না। পণ্য তিনটি বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে।
এদিকে কয়েক মাস ধরে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ডিম, আলু ও পেঁয়াজের মূল্য নিয়ে কারসাজি করছে। তারা অতি মুনাফা করতে প্রতি পিস ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১৫-১৬ টাকায় নিয়ে ঠেকায়। আলুর কেজি ৫০ ও পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ১০০ টাকায় বিক্রি করে।
ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রণে গত ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকা, প্রতিকেজি আলু ৩৫-৩৬ এবং পেঁয়াজের দাম ৬৪-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাজারে এই তিন পণ্যের দাম কিছুটা কমলেও সরকার নির্ধারিত দাম মানা হচ্ছে না।
রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিকেজি আলু এখনো ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা ও প্রতি পিস ডিম ১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে গত বুধবার রাজধানীতে একটি সেমিনারে ডিম-আলু-পেয়াঁজসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বাজারে বেঁধে দেওয়া হলেও তা কার্যকর না হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সেসময় তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতামত দিতে দেরি হওয়ায় ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকারের আদেশে অসাধু ব্যবসায়ীরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে মূল্য নির্ধারণ করলেও ব্যবসায়ীরা তা মানছে না। বাজারে তদারকি সংস্থা অভিযান পরিচালনা করেও তা কার্যকর করতে পারছে না।
তারা বলছে সিন্ডিকেট ভাঙবে, না পারলে আমদানির সুপারিশ করা হবে। এতে অসাধুরা আরও সুযোগ পায়। তাই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের একটি শক্তিশালী পলিসি থাকতে হবে। তা না থাকলে অসাধুদের কারসাজি রোধ করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, আলুর দাম কারা বাড়াচ্ছে সে তথ্য আমরা সরকারকে দিয়েছি। কোল্ড স্টোরেজে যে পরিমাণ আলু আছে তা দিয়ে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দেশের চাহিদা মেটানো যাবে।
কিন্তু সংরক্ষণকারীরা অতিমুনাফার লোভে বাড়তি দরে বিক্রি করছে। তিনি জানান, কৃষকের মাঠ থেকে পরিবহণ খরচ ও কোল্ড স্টোরেজ ভাড়া মিলে এক কেজি আলুর খরচ হয় ১৮-২০ টাকা। সংরক্ষণকারীরা ৬-৭ টাকা লাভ করে আলু বিক্রি করলে কোল্ড স্টোরেজ থেকে ২৬-২৭ টাকায় বিক্রি করতে পারে। সেটাই করা উচিত।
কিন্তু কোল্ড স্টোরেজে প্রতি কেজি আলু ৩৪-৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এটা ২৭ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। আর বিভিন্ন হাত ঘুরে ভোক্তা পর্যায়ে ৩৬ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ আলু কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ এখনো কোথাও কোথাও ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে আলুর মূল্য নির্ধারণের পর ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, সাত দিনের মধ্যে আলুর দাম ঠিক করা হবে। এর পর অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাজারে তদারকি করা হয়। পাশাপাশি তিনি নিজে সরেজমিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আলুর কোল্ড স্টোরেজে তদারকি করেন। কিন্তু বাজারে মূল্য ঠিক করতে পারেননি।
বরং বুধবার রংপুরে তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা কোল্ড স্টোরেজে আলুর দর ২৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছি। এরপরও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও কোল্ড স্টোরেজের কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট করে আলুর বাজার অস্থির করে তুলেছেন। আমরা এসব সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করছি। আরও তিন-চার দিন দেখব। এর মধ্যে সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে ডিমের মতো আলুও আমদানির জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হবে।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি সূত্র জানায়, সরকার ডিমের দাম বেঁধে দেওয়ার পর পাইকারি বাজারে দাম কিছুটা কমেছে। খুচরা বাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু সবাই জানে ডিমের দাম নিয়ে কারা কারসাজি করে। তাদের নাম সরকারসংশ্লিষ্টদের জানা। চাইলেই তারা সমাধান করতে পারে। কিন্তু কেন করছে না জানি না।
রাজধানীর তেজগাঁও পাইকারি ব্যবসায়ী শাহীন বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে এখনো কারসাজি চলছে। আমদানিকারকরা মূল্য এখনো বাড়িয়ে রেখেছে। সে কারণে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম কমছে না।
এদিকে রাজধানীর খুচরা বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে নতুর করে ব্রয়লার মুরগি, মসুর ডাল, আদা ও লবণের দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭৫-১৮৫ টাকা, যা সাত দিন আগে ১৭০-১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
প্রতিকেজি ছোট দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকা। যা সাত দিন আগে ১২৫-১৩৫ টাকা ছিল। পাশাপাশি প্রতিকেজি আমদানি করা আদা বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকা। যা আগে ২৫০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি লবণের দাম ২ টাকা বেড়ে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সবমিলিয়ে লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে নিত্যপণ্যের বাজার। সরকার ৩টি পণ্যের ওপর দাম নির্ধারণ করে দিলেও তার প্রভাব নেই দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলার বাজারেও। সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে আলু, ডিম ও পেঁয়াজ। যদিও বরিশালে উধাও হয়ে গেছে দেশি পেঁয়াজ। তবে কম দামে মিলছে এলসি (ভারতীয়) পেঁয়াজ। নানা অজুহাত দেখিয়ে বাড়তি মূল্যে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন এই তিন পণ্য।
অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, সরকার কঠোরভাবে এদের দমন করতে না পারলে ভোক্তারা বিপাকে পড়বে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৪৫ থেকে ৪৭ টাকা, দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭২-৭৫ টাকা আর ডিম প্রতিপিস বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকা দরে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন