আলোচিতদের জয়-পরাজয়ের গল্প

দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) এবারের নির্বাচন শেষ হলেও আলোচনায় রয়ে গেছেন সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস), সহ-সাধারণ সম্পাদকসহ (এজিএস) শীর্ষ কয়েকটি পদে হেরে যাওয়া প্রার্থীরা। সম্ভাব্য বিজয়ীদের তালিকায় নাম থাকলেও চূড়ান্ত ফলে তারা কেন পরাজিত হলেন, তা নিয়ে নানা ব্যাখ্যা উঠে আসছে বিশ্লেষক ও রাজনীতি সচেতন শিক্ষার্থীদের আলোচনায়।

বিশেষ করে ভিপি পদে ছাত্রদলের প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের পরাজয়ের কারণ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৭০৮ ভোট। ভিপি পদের স্বতন্ত্র আলোচিত প্রার্থী শামীম হোসেন ৩ হাজার ৮৮৩ ভোট পেয়ে হয়েছেন তৃতীয়। ৩ হাজার ৩৮৯ ভোট পেয়ে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের উমামা ফাতেমা হয়েছেন চতুর্থ। আর বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের আবদুল কাদের পঞ্চম হয়েছেন ১ হাজার ১০৩ ভোট পেয়ে। অথচ হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে তাদের মধ্যে যে কেউ ভিপি হতে পারেন বলে আলোচনা ছিল। ছাত্রদল প্রার্থীর ভিপি পদে হারের অন্যতম কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়মিত ছাত্রদের হাতে সংগঠনের নেতৃত্ব না থাকা, শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচির ঘাটতি এবং ইতিবাচক প্রচারের বদলে অন্যকে দোষারোপ। ছিল নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও। তবে বড় চমক দেখিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন। নারীদের একচেটিয়া ভোট পেয়ে জুলাইয়ের সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা ভিপি হয়ে যেতে পারেন—এমন আলোচনার মধ্যে তার অবস্থান দাঁড়িয়েছে চতুর্থ। তার খারাপ ফলের পেছনে শক্তিশালী ছাত্র সংগঠনের সমর্থন না পাওয়া এবং মাঠপর্যায়ে কার্যকর প্রচার জমাতে না পারা অন্যতম কারণ। অন্য প্রার্থীদের তুলনায় ছাত্ররাজনীতির অভিজ্ঞতাও কম উমামার, সংগঠনের নেতৃত্বে ধারাবাহিকতার অভাব থাকায় শিক্ষার্থীরা তার ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। একই আদর্শ ও শিক্ষার্থীগোষ্ঠীর একাধিক প্রার্থী থাকায় ভোট ভাগ হয়ে যায়। উমামার প্রচার ছিল মূলত ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ। হলভিত্তিক ও ক্যাম্পাসের বাইরের শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি পৌঁছাতে পারেননি। নির্বাচনী ইশতেহার আকর্ষণীয় হলেও সেটি সাধারণ ভোটারদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছেনি। ভিপি পদের প্রার্থী হিসেবে পঞ্চম অবস্থানে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রার্থী আবদুল কাদেরও পাননি প্রত্যাশিত ফল। বিশ্লেষকদের মতে, তার খারাপ ফলের পেছনে একাধিক কারণের অন্যতম হলো বৃহৎ ও মূলধারার ছাত্র সংগঠনগুলোর মতো শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো না থাকা। প্রচলিত ছাত্ররাজনীতির ভোটকেন্দ্রিক কৌশল ও জোটে অংশ নিতে পারেননি কাদের।

অন্যদিকে, জিএস পদের শীর্ষ পাঁচজনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিবিরের প্রার্থী এস এম ফরহাদ জিতেছেন ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়ে। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারী হামিম পেয়েছেন ৫ হাজার ২৮৩ ভোট। ৪ হাজার ৯৪৯ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন বামপন্থি সাতটি ছাত্র সংগঠনের যৌথ প্যানেল প্রতিরোধ পর্ষদের মেঘমল্লার বসু। স্বতন্ত্র আরাফাত চৌধুরী ৪ হাজার ৪৪ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের আবু বাকের মজুমদার ২ হাজার ১৩১ ভোট পেয়ে হয়েছেন পঞ্চম। ফরহাদ যে পরিসরে প্রচার ও সোশ্যাল মিডিয়ায় হাইফ তুলেছিলেন তার আশপাশেও ছিল না অন্য প্রার্থীরা। হামিমের ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ভালো পরিচিতি থাকলেও ছাত্রদলের ট্যাগিং রাজনৈতিক শিকার হন তিনি। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন তিনি জিএস হচ্ছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিবিরের নানামুখী কৌশলের পাল্টা কৌশল গ্রহণ করতে না পারায় হার মানতে হয়েছে। তুলনামূলক ভালো করেছেন মেঘমল্লার বসু। তিনি কার্যকর ও সুসংগঠিত ছাত্র সংগঠনের সমর্থন পেয়েছেন। তার পক্ষে কেন্দ্রীয় এবং হলভিত্তিক ভোটাররা একযোগে কাজ করেছে, যা ভোট সংগ্রহে সহায়ক হয়েছে। ক্যাম্পাসে তার দৃশ্যমান নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা শিক্ষার্থীদের আস্থা ও সমর্থন জাগিয়েছে। জিএস পদে চমক দেখিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত চৌধুরী। জুলাইয়ে সম্মুখ সারিতে থাকলেও সাংগঠনিক অদক্ষতায় ভালো করতে পারেননি বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সংগঠন বাগছাসের প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার।

এজিএস পদে চমক দেখিয়ে শিবিরের মহিউদ্দীন খান পেয়েছেন ১১ হাজার ৭৭২ ভোট। ছাত্রদলের তানভীর আল হাদী মায়েদ পেয়েছেন ৫ হাজার ৬৪ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরী পান ৩ হাজার ৮ ভোট। মহিউদ্দীনের একাডেমিক ফল ও তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির পাশাপাশি শিবিরের হাইফের কাছে পরাজিত হতে হয়েছে অন্য প্রার্থীদের।