আ.লীগ আগের নির্বাচনী অঙ্গীকার কতটা পূরণ করেছে?
২০১৪ সালের সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল, তাতে তাদের সরকারের আগের মেয়াদের কর্মসূচী অব্যাহত রাখার পাশাপাশি গণতন্ত্র, সুশাসন, থেকে শুরু করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নানা কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছিল। এসব অঙ্গীকার আওয়ামী লীগ কতটা পূরণ করতে পেরেছে?
২০১৪ সালের নির্বাচনে যেহেতু বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি, তাই ভোটে জিততে আওয়ামী লীগকে কোন কষ্টই করতে হয়নি। অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের প্রার্থীরা এমপি হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তারপরও এই নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল।
আওয়ামী লীগের সেই ইশতেহারের শিরোণাম ছিল “শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।’
কী ছিল সেই ইশতেহারে?
লেখক-গবেষক মহিউদ্দীন আহমেদ বলছেন, বিএনপি যেহেতু ঐ নির্বাচন বর্জন করেছিল, তাই নির্বাচনী ইশতেহারটি আওয়ামী লীগের কাছে তখন অত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
“২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটটা একটু আলাদা ছিল তো, বলা যায় আওয়ামী লীগ একটা ওয়াকওভার পেয়েছিল। যেহেতু ঐ সময়ের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। ঐ ইশতেহারটি আসলে তখন অত মুখ্য ছিল না। তবে একটা জিনিস বোঝা গিয়েছিল যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেছিল, সেটাই তারা অব্যাহত রাখবে এবং সেভাবেই কিন্তু তারা প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচশালা পরিকল্পনার ধারাটি বজায় রেখেছে।”
ইশতেহারে যেসব অঙ্গীকার আওয়ামী লীগ করেছিল, তার কতটা তারা পূরণ করতে পেরেছে?
দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম মনে করেন, এক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট সফল হয়েছেন।
“সবচেয়ে বড় সাফল্য আমি মনে করি, গণতন্ত্র, নির্বাচন এবং কার্যকর সংসদ, এই তিনটি আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল, এগুলো কিন্তু আমি বলবো দারুণভাবে সফল হয়েছে। আবার অন্যদিকে আপনি যদি আর্থ-সামাজিক দিকটি দেখেন, তাহলে আমাদের যে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়, এত ব্যাপক সোশ্যাল সেফটি নেটতো তথাকথিত সোশ্যালিস্ট কান্ট্রিতেও এরকম নেই।”
তাদের প্রবর্তন করা বেশ কিছু কর্মসূচীর কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করলেনঃ
“যেমন বৃদ্ধদের জন্য ভাতা, পঙ্গুদের জন্য ভাতা, কিংবা অটিস্টিক যারা তাদের জন্য ভাতা। এমনকি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েদের জন্য ভাতা। এর পাশাপাশি ছেলে-মেয়েরা, বিশেষ করে মেয়েরা যাতে স্কুলে থাকে, যাতে তাদের লেখাপড়ায় ধরে রাখা যায়, তাদের জন্য একেবারে স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করে দেয়া। এই যে কাজগুলো, যা আমাদের করার কথা ছিল, এর সবগুলোই আমরা অর্জন করেছি। শিক্ষার হার যদি ধরেন, তাহলে আমরা অনেকদূর এগিয়ে গেছি।”
সমালোচকরা যা বলছেন:
সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন নামের বেসরকারি সংস্থাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী অঙ্গীকার নিয়ে এক সময় কিছু কাজ করেছে। প্রতিষ্ঠানের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যেসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসলে কোন অগ্রগতি নেই।
“তাদের এই নির্বাচনী ইশতেহারে তারা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছিল সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এর অধীনে তারা নয়টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। একটি হচ্ছে শান্তি ও স্থিতিশীলতা, সংবিধান ও সংসদ, জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, নির্বাচন ব্যবস্থা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ। দুর্ভাগ্যবশত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব একটা অগ্রগতি আমরা দেখিনি।”
মিস্টার মজুমদার বলছেন, এসব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার শুধু যে তাদের অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, গত পাঁচ বছরে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বরং উল্টো পথে হেঁটেছে:
“আমরা কর্তৃত্ববাদের পথে হাঁটছি, নিঃসন্দেহে। অনেকগুলো পরিবর্তন হয়েছে, যেমন আমরা কতগুলো আইন করেছি। যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। একটা আইনকে আসলে অস্ত্রে পরিণত করে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। আমাদের অনেক মৌলিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার- যেগুলো সংবিধানে স্বীকৃত, সেগুলো সংকুচিত হয়েছে দুর্ভাগ্যবশত।”
তবে আওয়ামী লীগের এইচ টি ইমাম এর জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে বলছেন, “অনেকে অনেক কথাই বলেন। যেমন আমি যদি গণতন্ত্রায়নের কথা বলি, এই বর্তমান পার্লামেন্টের কথাই ধরুণ, যে যাই বলুন, এখানে যে জবাবদিহিতা, যে পরিমাণ আইন তারা গ্রহণ করেছেন, সেটা তো একটা বিরাট কাজ। যেমন মস্তবড় একটা কাজ হয়েছে, ৭২ এর যে সংবিধান ফিরিয়ে আনা। সেই সংবিধানের মৌলিক অধিকারের যে সমস্ত বিষয়, সেগুলো সমস্ত পুনঃস্থাপন করে, সংবিধানকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।”
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
বিগত সরকার বড় বড় যেসব নির্বাচনী অঙ্গীকার বরখেলাপের কথা সমালোচকরা অন্যতম উদাহারণ হিসেবে সামনে আনছেন, তার একটি হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা।
লেখক-গবেষক মহিউদ্দীন আহমেদ বলছেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাপারে প্রশ্ন আছে। যেমন নিম্ন আদালতকে এখনো নির্বাহী বিভাগের অধীনেই কাজ করতে হয়, তাদের ইঙ্গিতে, ইশারায়। উচ্চ আদালতেও বিচারক নিয়োগের যে প্রক্রিয়াটি, সেটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। সুতরাং নানাভাবে নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করে। এর ফলে বিচার বিভাগ ঠিক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সাম্প্রতিককালে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে যে বিতর্কটি হয়েছিল, সিরিয়াস একটি অভিযোগ ছিল, যে বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না।”
এর পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা এবং মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও সরকার মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন তিনি, যেটি ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার:
“অভিযোগগুলো হচ্ছে যে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা, সাদা পোশাকে গ্রেফতার করা, মাঝরাতে গিয়ে গ্রেফতার করা, এগুলো অতীতে কখনো ছিল? তারপরে হঠাৎ করে গুম হয়ে যাওয়া বা আরও কিছুদিন পরে তাদের মৃতদেহ পাওয়া, এধরণের অনেক গুম এবং খুনের ঘটনা ঘটেছে। এই জিনিসগুলো আসলে বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।”
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সাফল্য:
কেবলমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেই সরকার তার অঙ্গীকার রক্ষা করেছে বলে মনে করেন মহিউদ্দীন আহমেদ।
“যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ তার অঙ্গীকার রেখেছে বলেই আমি মনে করি। এবং এই যুদ্ধাপরাধ আদালতটি চালু আছে। এখনো এটা কাজ করে যাচ্ছে। এব্যাপারে আমি বলবো যে মোটামুটি সরকারের ভূমিকা ইতিবাচক।”
দুর্নীতি দমন
আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি দমনে আইনি, সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করার কথা বলা হয়েছিল। এক্ষেত্রে গত ৫ বছরে সরকারের রেকর্ড কী?
সুজনের বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন এক্ষেত্রেও সরকার আসলে উল্টোপথে গেছে।
“আমরা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি দেখেছি। উন্নয়নের নামে যে বিরাট বিরাট অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর ব্যয়সীমা বার বার বেড়ে যাচ্ছে। এসব প্রকল্পের একটা বিরাট অংশই কিন্তু স্বার্থান্বেষীদের পকেটে যাচ্ছে। দুর্নীতি- দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। পুলিশ এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দলীয়করণ চরম আকার ধারণ করেছে। এবং এটাই এখন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
অর্থনীতি এবং দারিদ্র দূরীকরণে সাফল্য
অর্থনীতি, অবকাঠামো এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব অঙ্গীকার ছিল, সেক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বেশি সাফল্যের দাবি করছে আওয়ামী লীগ। বাস্তবে আসলে অবস্থাটা কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা মনে করেন, এক্ষেত্রে সরকার আসলেই কিছু সাফল্য দাবি করতে পারে।
“গুরুত্বপূর্ণ যে সূচকগুলো রয়েছে, যেমন মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধির হার, দারিদ্র দূরীকরণ, এসব ক্ষেত্রে আমরা দেখি, মোটামুটি সাফল্য এসেছে। তবে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ২০২১ সাল নাগাদ দশ শতাংশের কথা বলা হয়েছিল, আমার কাছে মনে হচ্ছে যে এটি একটু বেশি উচ্চাভিলাষী। তবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের প্রবৃদ্ধি কিন্তু যথেষ্ট ভালো।”
তিনি বলেন, “দারিদ্র দূরীকরণের দিকেও যদি আমরা দেখি, যা লক্ষ্যমাত্রা ছিল, সরকারের অর্জন তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যে হারে দারিদ্র দূরীকরণ হয়েছে, সেই হারটা অবশ্যই ইতিবাচক।”
বড় অবকাঠামো প্রকল্পে ধীরগতি
তবে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের ক্ষেত্রে সরকার প্রত্যাশিত অগ্রগতি দেখাতে পারেনি বলে মনে করেন সায়মা হক বিদিশা।
“বড় বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে, মেগা প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে, যেটা আশা করা হয়েছিল, যে হারে বাস্তবায়ন হবে বা যে গতিতে বাস্তবায়ন হবে, আমরা কিন্তু সেই গতিটা দেখতে পাচ্ছি না। সুতরাং কাজ আগাচ্ছে, কিন্তু কাজ আগাবার যে গতি, সেই গতিটা কিন্তু ধীর।”
আওয়ামী লীগের এইচ টি ইমাম অবশ্য পদ্মা সেতুর মত প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের জন্য দায়ী করছেন তার ভাষায় আন্তর্জাতিক চক্রান্তকে। এইচ টি ইমাম দাবি করছেন, সমালোচকরা যাই বলুক, তারা তাদের অঙ্গীকারের বেশিরভাগটাই পূরণ করতে পেরেছেন।
-বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন