স্যাটেলাইটধারী ৫৭তম রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ আজ রাতেই

ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ে বাংলাদেশ

ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার (১০ মে) রাতে মহাকাশে যাবে দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর বিশ্বের ৫৭তম নিজস্ব স্যাটেলাইটের অধিকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বাঙালির এই জাতিরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের ৩৯-এ লঞ্চ প্যাড থেকে বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১২ মিনিট থেকে ৪টা ২২ মিনিটের মধ্যে উপগ্রহটি উৎক্ষেপণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য আনুষ্ঠানিক সময় ঘোষণা করেছে। ভিজিটর কমপ্লেক্সে দর্শকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে স্পেস সেন্টারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার ফ্লোরিডার স্থানীয় সময় ৪টা ১২ মিনিট থেকে ৬টা ২২ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে। এ দৃশ্য দেখতে বাড়তি অর্থ গুনতে হবে না। নিয়মিত ট্যুরের অংশ হিসেবে ৪৮ দশমিক ৮০ ডলার দিয়ে টিকেট কেটে কেনেডি স্পেস সেন্টার ঘোরার পাশাপাশি উৎক্ষেপণের দৃশ্যও দেখা যাবে।

এবারই প্রথমবারের মতো কেনেডি স্পেস সেন্টারের ব্লক-ফাইভ ভার্সনের নতুন ফ্যালকন-৯ রকেটে করে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হবে। অ্যাপোলো বা সেটার্ন ভিজিটর সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণের দৃশ্যটি সরাসরি দেখা যাবে।

এদিকে উৎক্ষেপণের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন। সরকারের নির্দেশে এই সম্প্রচার প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিয়েছে দেশের সব জেলা-উপজেলা প্রশাসন। এ উপলক্ষে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমসহ বাংলাদেশ সরকার ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ৩০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অরল্যান্ডো শহরে পৌঁছেছে।

দলটিতে আরো আছেন সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, ইমরান আহমেদ ও বিটিআরসির চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ। স্পেস এক্সের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ছাড়াও উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। উপগ্রহ উৎক্ষেপণের এ ঘটনা মঙ্গলবার রাত থেকেই ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। অপেক্ষায় রয়েছে দেশ ও দেশের বাইরে থাকা কোটি কোটি বাংলাদেশি। স্পেস এক্সের উৎক্ষেপণযান বা রকেট ফ্যালকন-৯ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে মহাকাশের ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত কক্ষপথে বয়ে নিয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়া ও ইতালির তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ২০ দিনের মধ্যে স্যাটেলাইটটিকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার উচ্চতার কক্ষপথে স্থাপন করা হবে। এরপর এর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হবে বাংলাদেশের হাতে। এর আগে এটি ফ্রান্স থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় কার্গো বিমানে করে উৎক্ষেপণস্থল অরল্যান্ডোর কেইপ কেনাভেরালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা স্যাটেলাইট নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের তালেস এলেনিয়া স্পেস এটি নির্মাণ করেছে। উৎক্ষেপণের পর উপগ্রহটি কক্ষপথে সংযুক্ত হয়ে পূর্ণ কর্মক্ষম হতে কমপক্ষে আরো দুই মাস সময় লাগবে। কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা, আগামী আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে।

তবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, আবহাওয়াজনিত কারণে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের তারিখ শেষ মুহূর্তেও পরিবর্তিত হতে পারে। এর আগে গত ৫ মে এটি উৎক্ষেপণের কথা ছিল। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আশঙ্কায় তা পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ গত ৭ মে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের তারিখ নির্ধারিত থাকলেও পরে এটি পিছিয়ে ১০ মে করা হয়। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৭ সালের অক্টোবরে। এরপর গত ডিসেম্বরে সার্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এটিকে মহাকাশে যাওয়ার উপযোগী ঘোষণা করা হয়। উপগ্রহ উৎক্ষেপণ উপলক্ষে বাংলাদেশিদের পদচারণে উৎসবমুখর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের মিয়ামি, কোকোয়া বিচ ও অরল্যান্ডো এলাকা।

বিশেষত সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে। ফ্লোরিডার পাশাপাশি নিউইয়র্ক, কানেকটিকাট, ম্যাসাচুসেটস, জর্জিয়াসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে শত শত প্রবাসী অরল্যান্ডো যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ইতিহাসের সাক্ষী হতে চান।

কারণ বাংলাদেশিদের কাছে এত দিন যা ছিল স্বপ্ন, এখন তা বাস্তবে রূপ পেতে চলেছে। আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠানের পরের দিন কোকোয়া বিচ হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস। সজীব ওয়াজেদ জয়ও ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেন।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ হাজার ৫৪৪ কোটি এবং অবশিষ্ট ১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা বিডার্স ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে জোগান দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুরে প্রাইমারি এবং রাঙামাটির বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে সেকেন্ডারি গ্রাউন্ড স্টেশনের নির্মাণকাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

মহাকাশে উৎক্ষেপণের পর এটি পরিচালনা, সফল ব্যবহার ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য এরই মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। নতুন এই কোম্পানিতে কারিগরি লোকবল নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।

নিজস্ব স্যাটেলাইট কাজ শুরুর পর বৈশ্বিক টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতার অবসান হবে। টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-গবেষণা, ভিডিও কনফারেন্স, প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু-১। এটিতে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে।

এর মধ্যে ২০টি দেশে ব্যবহার হবে। বাকি ২০টি ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং ভি-স্যাট সংস্থাগুলো বিদেশি স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ খাতে ব্যয় করছে বছরে ১৪ মিলিয়ন ডলার। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এই বিপুল অর্থ দেশেই রাখবে।