ইভিএমে নির্বাচন : কী বলছে ভারতের অভিজ্ঞতা?
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের ব্যবহার আদৌ হবে কিনা, বা আংশিকভাবে কোথাও কোথাও এটা কাজে লাগানো যায় কিনা–তা নিয়ে আলোচনা চলছে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেশী ভারতে ইভিএমের ব্যাপক ব্যবহার কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, সেই প্রশ্নটাও খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
ভারতে গত দুই দশকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, এমন বহু কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইভিএম নিয়ে ভারতেও প্রতিক্রিয়া একরকম মিশ্রই বলা যেতে পারে।
ইভিএমের প্রযুক্তি বুথ দখল, রিগিং বা জোর করে ব্যালটে ছাপ দেওয়া (ভারতে যাকে বলা হয় ‘ছাপ্পা ভোট’) ঠেকাতে ভীষণ কার্যকরী– এটা প্রায় সবাই মানছেন। কিন্তু ইভিএমের ‘মাদারবোর্ড’ ম্যানিপুলেট করে ভোটের ফলটাই আমূল বদলে দেওয়া যায় কিনা, এটা নিয়ে ভারতে পরিষ্কার দু’রকম বক্তব্য আছে। রাজনৈতিক দলগুলোও এ ব্যাপারে দু’ভাগ।
এমনকি, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ভারতের আগে ইভিএম প্রযুক্তি রফতানি করেছে। সেসব দেশেও কোথাও মসৃণভাবে এটা কাজ করেছে, আবার কোথাও জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের।
মাগুরা উপনির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে পারবে ইভিএম?
বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাসে একটা কলঙ্কজনক অধ্যায় ১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনির্বাচন— যা ব্যাপক অনিয়ম, বুথ দখল ও প্রশাসনিক মদতে ভোট কারচুপির সঙ্গে প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। ভারতেও নানা নির্বাচনে এ ধরনের অভিযোগ হরহামেশাই উঠতো। কিন্তু প্রায় দুদশক আগে ইভিএম চালু হবার পর থেকে সেটা ধীরে ধীরে ইতিহাস হয়ে গেছে।
ভারতের সাবেক একজন আমলা ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক প্রধান নির্বাচনি কর্মকর্তা মীরা পান্ডের কর্মজীবনে ডাকসাইটে কর্মকর্তা বলে খ্যাতি ছিল। তিনি এই প্রতিবেদককে ব্যাখ্যা করছিলেন— বিষয়টা কিভাবে কাজ করে।
‘আমি টেকনিক্যাল ব্যাপারটা বলতে পারবো না। কিন্তু ইভিএমের একটা দারুণ ব্যাপার হলো— এখানে একটা ভোটের বোতাম টেপার পর অন্তত এক বা সোয়া মিনিট আগে দ্বিতীয়বার বোতাম টেপা যায় না। বা টিপলেও ধরে ফেলা যায়, কত ঘন ঘন বোতাম টেপা হয়েছে।’
‘ফলে একটা বুথ দখল করে গুন্ডারা আধঘণ্টার মধ্যে কয়েকশ’ ব্যালটে ছাপ মেরে দেবে– এ জিনিস ইভিএমে সম্ভবই নয়। অথবা অন্যভাবে বললে, একটা বুথে যদি সাত-আটশো ভোট থাকে, তাহলে পুরো ফল রিগিং করতে তাদের প্রায় সারাদিন ধরে বুথটা দখল করে রাখতে হবে। আজকের যুগে সেটাও অসম্ভব।’
মীরা পান্ডে একারণেই বিশ্বাস করেন, জবরদস্তি ভোট ঠেকাতে বা বুথ দখল আটকাতে ইভিএম খুব কার্যকরী একটা জিনিস। ইভিএম চালু হওয়ার ফলে নির্বাচনি ফল ঘোষণাও ভারতে অনেক সহজ, অনেক দ্রুত হয়েছে।
তার মতো অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশেও যদি ইভিএম চালু করা যায়, তাহলে হয়তো এটা নিশ্চিত করা যাবে যে, মাগুরার মতো ঘটনা আর কখনও ঘটবে না।
ইভিএমেও কারসাজি করা সম্ভব?
আপাতত এই প্রশ্নটিকে ঘিরেই ভারতের রাজনৈতিক মহল দ্বিধাবিভক্ত। এতটাই যে, দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পর্যন্ত বলছে, ইভিএমের ওপর তাদের আস্থা টলে গেছে। দলের নেতা গুলাম নবী আজাদ ইভিএমের বদলে আবারও পুরনো কাগজের ব্যালট চালুরও দাবি জানিয়েছেন।
ইভিএম ভারতে চালু হয়েছে প্রায় দু’দশক হতে চললো। প্রথমে সীমিত আকারে, পরে সারা দেশজুড়ে। প্রথম দশ বছরে তেমন কোনও অভিযোগ-আপত্তি না উঠলেও পরের দশ বছরে কিন্তু ইভিএম নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
গত কয়েক বছরে বিরোধী দলগুলো দেশের নানা প্রান্তে অভিযোগ করেছে— বিভিন্ন ইভিএম যন্ত্র এমনভাবে ‘ম্যানিপুলেট’ করে রাখা হয়েছিল যে, আপনি যে চিহ্নেই ভোট দিন না কেন, সেটা নাকি গিয়ে পড়েছে বিজেপির ‘পদ্ম’তেই।
দিল্লিতে ক্ষমতায় আছে যে আম আদমি পার্টি, তাদের বিধায়ক সৌরভ ভরদ্বাজ আইআইটি থেকে পাস করা একজন প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার। তিনি গত বছর দিল্লি বিধানসভায় একটি ডামি ইভিএম মেশিন নিয়ে এসে দাবি করেছিলেন, সেগুলো খুব সহজেই ‘হ্যাক’ করা সম্ভব।
সৌরভ ভরদ্বাজ এই প্রতিবেদককে এদিন বলছিলেন, ‘প্রতিটি ইভিএমের একটা গোপন সাংকেতিক কোড থাকে। সেটা জানলেই যে কারও পক্ষে ইভিএমে ভোটের ফল পাল্টে দেওয়া সম্ভব।’
তার মতে, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে ইভিএম একটা ‘প্রযুক্তিগত কলঙ্ক’। শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোনও দেশেই এই প্রযুক্তি চালু করা অনুচিত বলে তার অভিমত।
ভারতের নির্বাচন কমিশন অবশ্য এই অভিযোগ মানতে একেবারেই নারাজ। মাসকয়েক আগে তারা একটি ‘হ্যাকাথন’ আয়োজন করে সব রাজনৈতিক দলকে ইভিএম হ্যাক করার চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছিল– তাতে কেউই সফল হয়নি বলে তাদের দাবি।
তারপরও বিভিন্ন দলের দাবিতে ভারতের নির্বাচন কমিশন বহু জায়গায় ইভিএমের সঙ্গে কাগজের ব্যালট (ভিভিপ্যাট) রাখারও ব্যবস্থা করেছে– যাতে ইভিএমের ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেই ব্যালট পেপার দেখে ভোট গোনা যায়। ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির অবশ্য এখনও ইভিএমে আস্থা অটুট।
আবার পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সিনিয়র এমপি কল্যাণ ব্যানার্জির কথায়, ‘ইভিএমকে ঘিরে সন্দেহ তৈরি হয়েছে তা তো দেখাই যাচ্ছে। আর পৃথিবীর বেশির ভাগ আধুনিক দেশ, ইউরোপ-আমেরিকা পর্যন্ত যেখানে কাগজের ব্যালটেই স্বাচ্ছন্দ্য, সেখানে ভারতের ইভিএম ব্যবহার করার দরকারটা কী?’
বতসোয়ানায় বিতর্ক, স্বাগত ফিজি-নামিবিয়াতে
এত শত বিতর্কের মধ্যেও গত কয়েক বছরে ভারতের ইভিএম প্রযুক্তি ‘রফতানি’ করা হয়েছে বিশ্বের বহু দেশেই।
ভারতে নির্বাচন কমিশনের হয়ে ইভিএম বানায় যে দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা– সেই ব্যাঙ্গালোরের ভারত ইলেকট্রনিকস লিমিটেড (ভেল) আর হায়দ্রাবাদের ইলেকট্রনিক করপোরেশন অব ইন্ডিয়া আফ্রিকা ও এশিয়ার নানা দেশে এই যন্ত্র বানিয়ে পাঠিয়েছে।
ভারতে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও নানা দেশে গিয়ে ইভিএমে ভোট পরিচালনার কাজ তদারকি করে এসেছেন।
যেমন, ২০১৪ সালে আফ্রিকার দেশ নামিবিয়াতে ভারতের ইভিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে ভোট হয়েছিল, তাকে অবাধ ও ত্রুটিমুক্ত বলে রায় দিয়েছিল প্রায় সব পক্ষই। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ফিজিতেও সাধুবাদ পেয়েছে ভারতীয় ইভিএম।
কিন্তু আফ্রিকারই আরেক দেশ বতসোয়ানাতে যখন ভারতের ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়, তখন তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সেই প্রতিবাদ আদালতেও গড়ায়।
এর পরেও এই ‘প্রযুক্তি হস্তান্তর’ নিয়ে গত কয়েক বছরের মধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে শ্রীলঙ্কা, মরিশাস, ফিলিপিন্স, নিউ গিনি, নেপাল, কেনিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের।
এমনকি, এবছর রাশিয়াতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মস্কোও ভারতের কাছ থেকে ইভিএম প্রযুক্তি নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
সুতরাং, ভারতের বাইরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ইভিএম প্রযুক্তি কোথাও সমাদৃত হয়েছে, আবার কোথাও বা তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশকেও সম্ভবত ইভিএম নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই পটভূমিতেই।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন