ইসরা ও মেরাজ এর শিক্ষা ও তাৎপর্য

শবে মেরাজ উপলক্ষে কিছু গোমরাহী ও বাতিল কাজ করা হয়। এ প্রসঙ্গে কুরআন-সুন্নাহতে নূন্যতম কিছু বর্ণিত হয় নি। তবে এ এভাবে দিবস পালন না করে যে কোন সময় মিরাজের ঘটনা বা শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা দোষণীয়নয়।

ইসরা ও মেরাজ মেরাজ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মহান অলৌকিক ঘটনাসমূহের একটি হল, মসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসায় রাতের বেলায় ভ্রমণ করানো ও সেখান থেকে সপ্তাকাশ ও তার ঊর্ধ্বে ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া। ইবনে তাইমিয়া বলেন, ইসরা-মেরাজ কোন মাসে, কোন দশকে ও সুনির্দিষ্ট কোন তারিখে হয়েছিল এ বিষয়ে আমাদের জানা মতে কোনো প্রমাণ নেই।

এমর্মে যা উল্লেখ হয়েছে তা কর্তিত ও বিভক্ত। অকাট্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব এই ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে- আনাস ইবনু মালিক থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “আমার নিকট বোরাক নিয়ে আসা হল, বোরাক হচ্ছে চতুষ্পদ জন্তু সাদা, লম্বা, গাধার চেয়ে বড় ও খচ্চর থেকে ছোট, তার দৃষ্টির শেষ প্রান্তে সে তার পা রাখে, তিনি বলেন: আমি তাতে সওয়ার হলাম, অবশেষে আমাকে বায়তুল মাকদিস নিয়ে আসা হল, তিনি বলেন: আমি তাকে সে খুঁটির সাথে বাঁধলাম যার সাথে নবীগণ বাঁধেন।

তিনি বলেন: অতঃপর আমি মাসজিদে প্রবেশ করি, তাতে দু’রাকাত স্বলাত আদায় করি, অতঃপর বের হই। অতঃপর জিবরিল আমার নিকট মদের ও দুধের পাত্র নিয়ে আসেন, আমি দুধের পাত্র গ্রহণ করি, জিবরিল আমাকে বলেন: তুমি ফিতরাত (স্বভাব) গ্রহণ করেছ, অতঃপর আমাদের নিয়ে আসমানে চড়েন …”।

[বুখারি ও মুসলিম কোন রাতে নবী (ﷺ)-এর ইসরা ও মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল তা সহিহ হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত নয়। যে রাতে নবী (ﷺ)-এর ইসরা ও মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল সেটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্ব যুগ থেকেই ওলামাগণের মাঝে মত পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন হাদীস না থাকায় আলেমগণ বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন: মিরাজের সময় নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেছেন, নবুওয়তের আগে।

কিন্তু এটা একটি অপ্রচলিত মত। তবে যদি উদ্দেশ্য হয়, যে সেটা স্বপ্ন মারফত হয়েছিল সেটা ভিন্ন কথা। অধিকাংশ আলেমগণের মত হল, তা হয়েছিল নবুওয়তের পরে। তবে নবুওয়তের পরে কখন সেটা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশটির অধিক মত পাওয়া যায়।

ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: পূর্ববর্তী যুগে এমন কোন মুসলিম পাওয়া যাবে না যে শবে মেরাজকে অন্য কোন রাতের উপর মর্যাদা দিয়েছে। বিশেষ করে শবে কদরের চেয়ে উত্তম মনে করেছে এমন কেউ ছিল না। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের একনিষ্ঠ অনুগামী তাবেঈনগণ এ রাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন কিছু করতেন না এমনকি তা আলাদাভাবে স্মরণও করতেন না। যার কারণে জানাও যায় না যে, সে রাতটি কোনটি।

যে কাজ রাসুল সা: যেভাবে করেছেন আমাদেরও সেভাবে করা উচিত। উমর ইবনুল খাত্তাব দেখলেন কিছু লোক একটা জায়গায় নামায পড়ার জন্য হুড়াহুড়ি করছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? তারা বলল, এখানে আল্লাহর রসূল (ﷺ) নামায পড়েছিলেন। তিনি বললেন, তোমরা কি তোমাদের নবীদের স্মৃতি স্থলগুলোকে সাজদার স্থান বানাতে চাও?

তোমাদের পূর্ববর্তী জমানার লোকেরা এ সব করতে গিয়েই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখানে এসে যদি তোমাদের কারো নামাযের সময় হয় তবে সে যেন নামায পড়ে অন্যথায় সামনে অগ্রসর হয়। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ২য় খণ্ড, ৩৭৬, ৩৭৭)

মেরাজ দিবস কিংবা শবে মেরাজ উদযাপন করা রজব মাসের অন্যতম মনগড়া ইবাদত। রজব মাসের সাতাইশ তারিখকে শবে মেরাজ পালনের জন্য নির্ধারণ করে নেয়া হয়েছে।শবে মেরাজ উপলক্ষে মসজিদ মসজিদে একত্রিত হওয়া, মসজিদে কিংবা মসজিদের মিনারে মিনারে মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো, এ উপলক্ষে অর্থ অপচয় করা, কুরআন তিলাওয়াত বা জিকিরের জন্য একত্রিত হওয়া, মেরাজ দিবস উপলক্ষে মসজিদে বা বাইরে সভা-সেমিনার আয়োজন করে তাতে মিরাজের ঘটনা বয়ান করা ইত্যাদি অনর্থক কাজ।

আল্লাহ তা’লার যিক্ র: আল্লাহর তাসবীহ (স্তুতি), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এবং তাকবীরের ফযীলত সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: ‘‘মেরাজের রাতে ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের সাথে আমার সাক্ষা হলে তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! তোমার উম্মাতকে আমার সালাম বলো এবং তাদেরকে এ সংবাদ দাও যে, জান্নাতের মাটি সুন্দর, পানি মিষ্টি, আর জান্নাত সমতল এবং এর বৃক্ষরাজি সুবহানাল্লাহ, আলহামদুল্লিাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার’’।

[তিরমিযী এটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী তাকে উত্তম বলেছেন] মুহাম্মাদ (ﷺ) থেকে অনেক অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয়েছে। এগুলির সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। এগুলির মধ্যে রয়েছে: (১) ইসরা ও মি’রাজ: অলৌকিকভাবে রাত্রিভ্রমন ও ঊর্ধ্বগমনমহান আল্লাহ কুরআনে বলেন: ‘‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমন করিয়েছেন মসজিদুল হারাম (মক্কার মসজিদ) থেকে মসজিদুল আকসা (যিরূশালেমের মসজিদ) পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য।” [সূরা ইসরা (বনী ইসরাঈল), ১ আয়াত।]এ আয়াত এবং বহুসংখ্যক সহীহ হাদীস প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মিরাজে গমন করেন।

বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে তা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত। উপরন্তু এই আয়াতটিও তা প্রমাণ করে। কারণ ‘বান্দা’ বলতে কুরআনে সর্বত্র আত্মা ও দেহের সমন্বিত মানুষকেই বুঝানো হয়েছে। এছাড়া আমরা জানি যে, কাফিরগণ ইসরা ও মি’রাজ (নৈশভ্রমন ও ঊর্ধ্বারোহ) অস্বীকার করে এবং একে অসম্ভব বলে দাবি করে। জ্ঞান, বিবেক বা মানবীয় বুদ্ধির দৃষ্টিতে এবং ধর্মগ্রন্থাবলির নির্দেশনার আলোকে জাগ্রত অবস্থায় সশরীরের এরূপ অলৌকিক নৈশভ্রমন ও ঊর্ধ্বারোহণ অসম্ভব নয়।

পরবর্তী বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কার মিরাজের সত্যতা প্রমাণিত করেছে।] শুধু এতটুকু বলা যায় যে, বিষয়টি অসম্ভব নয়, তবে অস্বাভাবিক বা সাধারণ নিয়মের বাইরে। সকল অলৌকিক কর্মই অস্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক বলেই তো অলৌকিক চিহ্ন বলে গণ্য করা হয়।

হাদিসে কুদসি :: উম্মতে মুহাম্মাদির ফযিলত হাদিস ৯৪ : মালিক ইবনু সা‘সা‘ থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন: … এখানে তিনি মেরাজের হাদিস বর্ণনা করেন, তাতে রয়েছে, “অতঃপর আমার ওপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত স্বলাত ফরজ করা হয়, অতঃপর ——তা পাঁচ করে দেয়া হয়। অতঃপর ঘোষণা দেয়া হয়: নিশ্চয় আমি আমার ফরদ্ব বাস্তবায়ন করেছি, আমার বান্দাদের থেকে হালকা করেছি, আমি এক নেকির প্রতিদান দিব দশ”।

[বুখারি ও মুসলিম]। কোন ব্যক্তি যদি প্রতি মাসে কিছু নফল সওম রাখে সে এমাসেও সেই ধারাবাহিকতা অনুযায়ী এ মাসে সওম রাখতে পারে, শেষ রাতে উঠে যদি নফল নামাযের অভ্যাস থাকে তবে তবে এ মাসের রাতগুলিতেও নামায পড়তে পারে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল অবস্থায় তাওহীদ ও সুন্নাহর উপর আ‘মাল করার তাওফীক দান করুন আমীন।