ইয়াবা বেচে কোটিপতি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রবিউল আলম
কোনো ধরনের বৈধ ব্যবসাপাতি না করেই কোটিপতি হয়ে গেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত টেকনাফের রবিউল আলম। গত পাঁচ মাসে তার ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকার কাছাকাছি লেনদেন হয়েছে।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এতো টাকা আসলো কীভাবে? কী তার ব্যবসা? কোথায় পেলো মূলধন?
একটি গাড়ির সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে শুধু রবিউলই নয়, তার বড়ভাই ফরিদুল আলম, রাশেদুল আলম, বাবা ছিদ্দিক আহমদ ও ভাবী রায়হানা আক্তারের ব্যাংক পাওয়া গেছে অস্বাভাবিক লেনদেন।
চট্টগ্রামে ৫০ হাজার ইয়াবা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি গাড়ি আটকের ঘটনার অনুসন্ধানে এসব তথ্য পেয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
চলতি বছরের ২৫ মার্চ কর্ণফুলী থানার পিএবি সড়কে চালকসহ সরকারি স্টিকার লাগানো একটি পাজেরো জিপ আটক করেছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ। জিপের মালিকের সন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া রবিউল, তার বড় ভাই ও বাবা সবাই ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। জিপটির মালিক ফরিদুল। রবিউলদের পুরো পরিবারের ব্যবসাই ইয়াবা।
পরবর্তীতে তদন্ত করতে গিয়ে তাদের ব্যাংক হিসাবে এ কয় বছরে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা লেনদেনের সন্ধান মেলে। ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় রবিউল, তার ভাই ও বাবাসহ চার সহযোগীর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে চার্জশিট দিয়েছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শিবু দাশ চন্দ।
তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরের সুপারিশ জানিয়ে সিআইডির কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া রবিউল আল আরাফাহ ব্যাংক টেকনাফ শাখায় একটি হিসাব (নম্বর ১০২১১২০০২৯৩২৪) খোলেন ২০১৫ সালের ২৮ মে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত উক্ত হিসাবে লেনদেন হয়েছে ৫৩ লাখ ২৭ হাজার একশো ৮৭ টাকা।
একই ব্যাংকে গত ২৭ মার্চ খোলা একটি মুদারাবা হিসাবে (নং ১০২১৩১৩৩৩৫৩৩৯) ৩০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। আয়ের উৎস হিসাবে জমির ব্যবসা দেখানো হলেও তার কোনো ট্রেড লাইসেন্স বা টিআইএন নম্বর নেই।
একইভাবে তার ভাই ফরিদুল আলমের নামে ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখায় দুটি, আল আরাফাত ব্যাংক টেকনাফ শাখায় তিনটি আলাদা আলাদা হিসাবে এক কোটি ৯০ লাখ তিন হাজার ৯১ টাকার লেনদেন হয়েছে। অধিকাংশ টাকা রাজধানীর নবাবপুর, রমনা, ইসলামপুর, গাজিপুর চৌরাস্তা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকা থেকে পাঠানো হয়েছে।
ফরিদুলের বাবা সিদ্দিক আহমদের নামে আল আরাফাহ ও জনতা ব্যাংক টেকনাফ শাখার চারটি হিসাবে তিন কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার নয় শত ৪৭ টাকার লেনদেন হয়েছে।
শুধু তাই নয়, ফরিদুলের স্ত্রী রায়হানা আক্তারের নামে আল আরাফাহ ও জনতা ব্যাংক টেকনাফ শাখায় দুটি হিসাবে ১৮ লাখ ১৮ হাজার চারশো ৮৪ টাকার লেনদেন হয়েছে। ফরিদুলের আরেক ভাই রাশেদুলের নামেও জনতা ব্যাংক টেকনাফ শাখায় একটি স্কুল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর রয়েছে। যাতে দুই লাখ ১০ হাজার একশো ৫৫ টাকার লেনদেনের তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবমিলিয়ে রবিউল, ফরিদুল, স্ত্রী রায়হানা, ভাই রাশেদুল ও বাবা সিদ্দিক আহমদের হিসাবে এ কয় বছরে ছয় কোটি ৪০ লাখ ৩৭ হাজার টাকার লেনদেন হয়েছে।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, বড় মাপের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ব্যাংকের হিসাবের তথ্য চেয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছি। বেশ কিছু ইয়াবা ব্যবসায়ীর অস্বাভাবিক লেনদেনের হিসাব ব্যাংক আমাদের কাছে পাঠিয়েছি। যাদের তথ্য পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশ কমিশনারকে আমরা লিখিতভাবে অবহিত করেছি। এসব তথ্য পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগে পাঠানো হবে। সিআইডি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
ডিসি শহীদুল্লাহ বলেন, অর্থের উৎস বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া গেলে ইয়াবা ব্যবসা বন্ধে সুফল আসবে পাশাপাশি ইয়াবা পাচারকারিরা ধরা পড়বে।
গত ২৫ মার্চ বিকেলে কর্ণফুলী থানার পিএবি সড়কে ফকিরনির হাট এলাকা থেকে সরকারি স্টিকার লাগানো ৫০ হাজার ইয়াবা নিয়ে চালকসহ একটি পাজেরো জিপ (চট্ট মেট্রো-ঘ ১১০২৮৯) আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় গত ১০ জুলাই সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শিবু প্রসাদ চন্দ।
গাড়ি চালক জসিম ছাড়া চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন, রবিউল আলম (২৪), তার বড় ভাই ফরিদুল আলম মেহেদী ওরফে মেহেদী হাসান (৩৫) বাবা সিদ্দিক আহমদ (৫০) সহযোগী শামসুল ওরফে শফিকুল ইসলাম (২৫), সৈয়দ আহমদ ওরফে সৈয়দ হোছাইন ও আবদুল মতলব।
আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে বলা হয়েছে, ফরিদ একজন পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী। নিজের পাজেরো জিপে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ও সরকারি স্টিকার লাগিয়ে মনোনীত ব্যক্তিকে ভুয়া সরকারি কর্মকর্তা সাজিয়ে কক্সবাজার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা পাচার করাত।
রবিউল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বের আড়ালে নগরীতে বসে কক্সবাজার থেকে পাঠানো ইয়াবা নগরীর বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতো। পথিমধ্যে পাজেরো জিপ কেউ আটক করলে নিজেকে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে গাড়ি ছাড়িয়ে নিতো।
গত ২৫ এপ্রিল উদ্ধার করা ৫০ হাজার ইয়াবা টেকনাফের শামসুল ইসলাম ওরফে শফিকুল ইসলাম, নুরু, সৈয়দ আহমদ ও আবুদল মালেকের কাছ থেকে নিয়েছিলেন রবিউলের বাবা সিদ্দিক আহমদ।
রবিউলের বিরুদ্ধে উখিয়া, টেকনাফ, রামু ও ঢাকার তেজগাঁও থানায় চারটি, তার বাবা সিদ্দিক আহমদের বিরুদ্ধে উখিয়া, টেকনাফ ও রামু থানায় ছয়টি এবং ফরিদুলের বিরুদ্ধে উখিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফ ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ছয়টি মামলা রয়েছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন