ঈদযাত্রা : নতুন সাজ নিচ্ছে ভাঙাচোরা লঞ্চ

রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের ডকইয়ার্ডগুলোতে এখন বিপুল কর্মযজ্ঞ। এই কর্মযজ্ঞ যে শুধু নতুন সৃষ্টির তা নয়, পুরনোর ওপর রং লাগিয়ে নতুন রূপ দেয়ারও, যা বরাবর ভয়ের কারণ হয় মানুষের। দীর্ঘদিন পড়ে থাকা ফিটনেসহীন ও ভাঙাচোরা অনেক লঞ্চ জোড়াতালি মেরামত আর রঙের প্রলেপ নিয়ে রূপ ধরছে নতুন সাজে।

এই নতুন রূপ দেয়ার যজ্ঞ চলছে রমজানের এক-দেড় মাস আগে থেকে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভিড় বাড়তে থাকলে নদীতে নামবে এসব ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান। তার আগেই কাজ সেরে নিতে দিন-রাত মখাটছেন ডকইয়ার্ডে নিয়োজিত শ্রমিকরা।

প্রতি বছর ঈদের আগে ডকইয়ার্ডগুলোতে এই চিত্র নিয়মিত ঘটনা। প্রশাসন এসব রোধে নানা ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চগুলো তরতর করে নেমে আসে নদীতে। ভেতর-বাহির বোঝাই যাত্রী নিয়ে ঢেউ তুলে ছুটে চলে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। মাঝপথে নষ্ট হওয়া কিংবা দুর্ঘটনায় পড়ার খবর আসে প্রায়ই।

এই প্রতিবেদক আজ ও গতকাল কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে ঘুরে এসেছেন। কথা বলেছেন কোনো কোনো মালিক ও শ্রমিকের সঙ্গে। তারা পুরনো লঞ্চ মেরামতের বিষয়টি অস্বীকার করছেন না। যুক্তি দিচ্ছেন তার পক্ষে। আবার সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের যখন কথা হয়, তারাও জানাচ্ছেন ঝুঁকিপূর্ণ এসব লঞ্চ চলাচল অবৈধ, যেকোনোভাবে রুখবেন তারা।

কেরানীগঞ্জের তেলঘাট থেকে মীরেরবাগ পর্যন্ত প্রায় ২৭টি ডকইয়ার্ড রয়েছে। প্রায় সব কটিতে ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ডকইয়ার্ডে বিভিন্ন নৌযান তৈরি, সংস্কার ও রঙের কাজ চলছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ডকইয়ার্ডে চলছে ফিটনেসবিহীন ও ভাঙ্গাচোরা লঞ্চ মেরামত, পুরোনো লঞ্চে রংসহ নানা ধরনের কাজ।

রহমান মিয়ার ডকইয়ার্ডে এমভি প্রিন্স, আওলাদ ও বোগদাদিয়া; সাত্তার খান ডকইয়ার্ডে নিউসান; চর কালীগঞ্জ অগ্রগতি ডকইয়ার্ড অ্যান্ড শিপবিল্ডার্সে পারাবত, সোনার তরী ও ময়ূর নামের তিনটি লঞ্চ; শরিফুল্লাহ ডকইয়ার্ডে দীপরাজ নামের লঞ্চগুলোর মেরামতের কাজ চলছে।

ডকইয়ার্ড কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদ সামনে রেখে অনেক লঞ্চমালিক দুই মাস আগে লঞ্চ ডকইয়ার্ডে ওঠানোর জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছেন।

আওলাদ লঞ্চের একজন সংস্কারকর্মী (সংগত কারণে নাম প্রকাশ করা হলো না) বলেন, ‘সব সময়ই ঈদের মৌসুমে আমাদের কাজ বেশি থাকে। এ সময় বেশি টাকা আয়ের জন্য লঞ্চমালিকরা পুরনো ফেলে রাখা লঞ্চগুলো মেরামতের জন্য ঘাটে ওঠায়। ঈদের মৌসুমে ১০ দিন লঞ্চ নদীতে চালাতে পারলেই তারা লাভের মুখ দেখতে পান। তাই আগেভাগে বিভিন্ন লঞ্চমালিক ডকইয়ার্ডের মালিকদের আগাম টাকা দিয়ে রাখেন।’

সোনারতরী লঞ্চের একজন সংস্কারকর্মীর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ঈদের মৌসুমে লঞ্চগুলো সাধারণত রং-চুনাসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সংস্কারের কাজ করা হয়। অন্য সময়ের তুলনায় এ সময় কাজের জন্য বেশি টাকা দেয়া হয়। তাই সংস্কারকর্মীরা ঈদের মৌসুমে দিন-রাত সংস্কার কাজে ব্যস্ত থাকেন।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) একজন কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ৪১টি নৌপথে শতাধিক লঞ্চ চলাচল করে। সাধারণ সময়ে প্রায়ই এসব লঞ্চ বোঝাই হয়ে চলাচল করে। ঈদের মৌসুমে যাত্রীর চাপ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এ অতিরিক্ত যাত্রীর লোভে কিছু অসাধু লঞ্চমালিক লক্কড়-ঝক্কড়, চলাচলে অনুপযোগী লঞ্চ সংস্কার ও রং করে চাকচিক্যময় করে তোলেন। কয়েক বছর ধরে বসা লঞ্চও ঘাটে আনা হয় ঈদযাত্রী পরিবহনে।

এসব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করছেন না ডকইয়ার্ডে ওঠানো অধিকাংশ লঞ্চের মালিক। তবে সব লঞ্চই যে লক্কড়-ঝক্কড় তা মানতে নারাজ তারা। তাদের দাবি, চলাচল উপযোগী লঞ্চও তারা ঈদের সময় সংস্কার করেন। তারা বলেন, দোতলা একটি লঞ্চ সংস্কার ও রং করতে চার-পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়। ঈদের আগে লঞ্চটি নামাতে পারলে পুরো খরচই উঠে আসে। কিন্তু অন্য সময় ওই টাকা ওঠানো অনেক কঠিন। তাই লঞ্চমালিকরা ঈদের মৌসুমকেই লঞ্চ সংস্কারের সঠিক সময় বলে মনে করেন।

সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে প্রায় আট হাজার লঞ্চ বিভিন্ন রুটে নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করছে। এর মধ্যে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নিবন্ধনকৃত লঞ্চ মাত্র দুই হাজার ৮২টি। আবার এ নৌযানগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কাগজপত্র জমা দিলে এক হাজার ৩৫৪টি লঞ্চকে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। তবে ত্রুটিপূর্ণ এসব লঞ্চ এখনো চলছে বলে সূত্রে জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নিয়ম হলো বার্ষিক জরিপের মাধ্যমে নৌপথে চলাচলকারী লঞ্চগুলোর ফিটনেস পরীক্ষা করে দেখা এবং ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলতে না দেওয়া। এই কাজের জন্য সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের ৩০ জন পরিদর্শক রয়েছেন। কিন্তু প্রকাশ্যেই চলছে এসব লঞ্চ।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর মোজাম্মেল হক বলেন, সার্ভে সনদ ছাড়া এবার কোনো লঞ্চকে ঘাটে ভিড়তে দেওয়া হবে না। এ ছাড়া এবার প্রতিটি ঘাটে ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এবার যে মাস্টাররা লঞ্চ চালাবেন, তাদের সার্টিফিকেটও পরীক্ষা করা হবে। সবকিছু তদারকির জন্য সার্বক্ষণিক নৌ-পুলিশের পাশাপাশি কোস্টগার্ড দায়িত্ব পালন করবে বলেও জানান তিনি।মোজাম্মেল হক আরও বলেন, অন্যবারের চেয়ে এবার কড়া নজরদারির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একটি লঞ্চও যেন অনিয়ম করতে না পারে, সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হবে।-ঢাকাটাইমসের সৌজন্যে