উচ্ছ্বসিত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2022/05/Padma-20220523081652.jpg)
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2025/02/475351977_1256003665483861_2959209934144112011_n.jpg)
স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জন্য মুখিয়ে আছে পুরো দেশ। উচ্ছ্বসিত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার মানুষ। সেতুর কাজ ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। পদ্মা সেতু এলাকায় গিয়ে এবং আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন প্রায় প্রতিদিনই শত শত মানুষ কেউ পরিবার নিয়ে, কেউ দলবল নিয়ে গাড়ি ভাড়া করে পদ্মা সেতু দেখতে আসছে। এ নিয়ে আলোচনায় মুখর পদ্মা সেতুর দুই পাড়। সেতুর আশপাশের বাসিন্দাদের মনেও আনন্দ। খরস্রোতা প্রমত্তা পদ্মা পারাপারে কত যে মানুষের প্রাণ গেছে। এখন সেতু মিলিয়েছে পাড়।
আবদুল জব্বার। বয়স ৫২-র কাছাকাছি। রাজধানীর বাংলাবাজারে কাগজের ব্যবসা করেন। মধ্য বাংলাবাজারেই তার বাসা। ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় গ্রামের বাড়ি। গত শনিবার মোটরসাইকেল নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছেন। দুপুরে মাওয়া ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করছেন। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তিনি। এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর ফেরিতে উঠতে হয়। তিনি বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে ১ ঘন্টায় ঢাকা থেকে ভাঙ্গায় যাওয়া-আসা যাবে।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জন্য বর্তমানে নদীর দুই তীরে শুরু হয়েছে উৎসবের জয়গান। চলছে নানা প্রস্তুতি। বিকেল হলে দুই তীরে শত শত মানুষ পদ্মা সেতুর বর্তমান দৃশ দেখার জন্য জড়ো হন। আবদুল জব্বার বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে অবহেলিত জনপদে সম্ভাবনার আরেক নাম হবে উন্নয়নের বাংলাদেশ। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার উন্নয়নে গড়ে উঠছে শিল্পকারখানা।
আর ইব্রাহীম নামের অপর একজন জানান, এখানে নতুন নতুন শিল্পকারখানা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বিপুল কর্মসংস্থানের আশা দেখাচ্ছে পদ্মা সেতু। পদ্মাপারের মানুষ শহর থেকে গ্রামে ফিরতে শুরু করেছেন।
সেতু কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে বলছেন ‘নিজেদের টাকায়’ পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রায় শেষ। উদ্বোধনের জন্য বর্তমানে ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ চলছে এখন। গত ১৭ মে টোলের হারও নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। আগামী মাসের শেষ সপ্তাহে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে স্বপ্নের এ সেতু। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, উদ্বোধনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এমন পরিকল্পনা সফল করতে ১৮টি প্রস্তুতিমূলক কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রচারাভিযান, স্টেজ প্যান্ডেল, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যগত, অতিথি আমন্ত্রণ, আপ্যায়ন- এরকম নানা উপখাতে ভাগ করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। একদিকে চলছে উদ্বোধনের প্রস্তুতি, অন্যদিকে চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ। দুই পাড়ের মেলবন্ধনে তৎপর পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ।
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারিখ যা-ই হোক প্রস্তুতির কমতি নেই। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি স্মারক নোট ও স্মারক রৌপ্য মুদ্রা মুদ্রণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু শীর্ষক স্মারক নোটের চূড়ান্তকরণ ও মুদ্রণের পর এ বছরের জুনের মধ্যে বাজারে ইস্যু করা হবে। আর রৌপ্য মুদ্রার ডিজাইন চূড়ান্ত করে আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডিসেম্বরের মধ্যে বাজারে ইস্যু করা সম্ভব হবে বলে সেতৃকর্তৃপক্ষ জানায়।
এদিকে স্মারক ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করা হবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে। এ জন্য ডাক ও টেলিযোগ বিভাগে অনুরোধ করা হয়। এর জবাবে ডাক বিভাগ জানিয়েছে, স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশে দুই লাখ টাকা ব্যয় হবে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে স্মারক ডাকটিকিটের ডাটাকার্ড প্রকাশের জন্য ২০০ শব্দ দিয়ে সেতুর বিবরণ পাঠানো হয়েছে।
এ উপলক্ষে দীর্ঘ সেতুটি বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্নের জাল বুনছেন দক্ষিণাঞ্চলবাসী। পদ্মাপাড়ের মানুষের স্বপ্নটা আরও বড় স্থানীয়রা জানান। এক্সপ্রেস হাইওয়ে সংলগ্ন শিবচরের প্রত্যন্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক শপিংমল। বসেছে নতুন নতুন হাটবাজার। এক সময়ের প্রত্যন্ত জনপদে ইতোমধ্যে জমির দাম বেড়েছে ১০-১৫ গুণ।
পদ্মা সেতুকে ঘিরে সরকার হাতে নিয়েছে বৃহৎ আবাসন প্রকল্প, বিসিক শিল্পনগরীসহ নানা পদক্ষেপ।
এদিকে দক্ষিণবঙ্গের প্রবেশদ্বার মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় অবতারণা হবে এক নৈসর্গিক দৃশ্যের। খুলে যাবে পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার। পাল্টে যাবে রাজধানীর কাছের এ অঞ্চলের অর্থনীতির চিত্রও।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, বহুল কাঙ্ক্ষিত সেতুটি বাস্তবায়নকে ঘিরে একসময়ের অবহেলিত পদ্মার পাড় এখন কর্মব্যস্ত অর্থনৈতিক ঝলমলে আলোকোজ্জ্বল জনপদের নাম। ঢাকা থেকে শুরু হওয়া পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেস হাইওয়ে শিবচর হয়ে পৌঁছেছে ফরিদপুরের ভাঙ্গায়।
এ পথেই রেললাইন বিস্তৃত হচ্ছে যশোর পর্যন্ত। শিবচরে দুটি স্টেশন, জাজিরায় একটি স্টেশনসহ জংশন রয়েছে ভাঙ্গায়। এক্সপ্রেস হাইওয়ের শিবচরের পাচ্চর মোড় নামক স্থানে গড়ে উঠেছে অন্তত পাঁচটি শপিংমল। যেখানে রয়েছে ক্যাপসুল লিফটসহ আধুনিক সুবিধাদী। আরও কয়েকটি মার্কেট নির্মাণও প্রক্রিয়াধীন। শিবচর অংশের এক্সপ্রেস হাইওয়ের পাশে গড়ে উঠেছে নতুন অন্তত ৮-১০টি হাটবাজার। নতুন রেলস্টেশন ঘিরেও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে অর্থনীতি।
স্থানীয় সূত্র আরো জানায়, পদ্মা সেতুসংলগ্ন শিবচরে ১০৮ একর জায়গায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী, ১৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
হারিয়ে যাওয়া তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তাঁতিসহ কাপড় ব্যবসায় জড়িতরা। শিবচর ইউনিয়নে বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের জন্য ৪০০ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। অলিম্পিক ভিলেজ নির্মাণেও জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে এক্সপ্রেস হাইওয়ে সংলগ্ন শিবচর, ভাঙ্গা ও সদরপুরে আড়িয়াল খাঁ তীরবর্তী এলাকায়।
এ ছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, বিনোদন, খেলাধুলা, আবাসনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে এই জনপদে।
শিবচরের মোল্লাকান্দির বাসিন্দা জয়নাল আকন মুঠোফোনে বলেন, পদ্মা সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়ক ও রেললাইনে আমাগো পরিবারের বসতভিটাসহ ৭৬ শতাংশ জমি গেছে। দেশের স্বার্থে আমরা সর্বস্ব দিছি। আগে এই এলাকায় যে জমির দাম ছিল ৩-৪ লাখ টাকা বিঘা। সেই জমির দাম এখন ৬০-৭০ লাখ টাকা।
এ ব্যাপারে শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি দক্ষিণাঞ্চল উন্নয়নের কথা জানান। তিনি বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ সেতুটিকে ঘিরে পদ্মাপাড়ের এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বেড়েছে কয়েকগুণ। সরকারের বড় বড় প্রকল্প ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আওতায় গড়ে উঠছে একটি ব্যতিক্রমী প্রাণী জাদুঘর। পদ্মা সেতুর কাজের পাশাপাশি জেলার শ্রীনগরের পদ্মা সেতু সার্ভিস এরিয়া-১ এ প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি দেখতেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসবে। জানা গেছে, ২৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর ৮৩টি, ১৬১ প্রজাতির পাখির ৩৯৮টি, ২৬ প্রজাতির উভচর প্রাণীর ৫৩টি নমুনা, ৩২১ প্রজাতির মাছের ৩৩৬টি, ৩০৬ প্রজাতির শম্বুকজাতীয় কোমলাঙ্গের প্রাণীর ৩০৮টি, ৫৯ প্রজাতির কঠিন আবরণযুক্ত জলজ প্রাণীর ৬৩টি, ১৮৩ প্রজাতির প্রজাপতি ও মথের ২২৮টি এবং পোকামাকড়ের মোট ২২২ প্রজাতির ৩৬১টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
এদিকে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর দুই পাশে ১২ দশমিক ৩ কিলোমিটার রেলিং স্থাপন করা হবে তিন ফুট উঁচু দেয়ালের ওপর। সেতুর দুই প্রান্তে তিন দশমিক ১৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্টে আরও ৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার রেলিং স্থাপন করা হবে। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ ইতিবাচক করার জন্য সেতু কর্তৃপক্ষ তৎপর রয়েছেন।
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2024/12/469719549_122234398946008134_2936380767280646127_n.jpg)
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন