ঋতুস্রাবের সময় ঘরের বাইরে রাখা ‘নারী নির্যাতনের’ সামিল
ঋতুস্রাবের সময় ও সন্তান প্রসাবের পর নেপালে নারীদের বাড়ির বাইরে এক খুপরি ঘরে রাখার প্রথা রয়েছে, এ প্রথাকে নারী নির্যাতন বলে সংজ্ঞায়িত করে নতুন একটি আইন করা হয়েছে। ওই আইনে এটাকে ‘মারত্মক’ অপরাধ বলা হয়েছে।
দেশটির প্রত্যন্ত গ্রামে ‘ছাউপাদি’ নামক একটি হিন্দু প্রথা রয়েছে- এই প্রথা অনুযায়ী ঋতুবতী মেয়ে ও সন্তান প্রসাবের পর চল্লিশ দিন নারীদের যে রক্তক্ষরণ হয় এই সময় তাদের অপবিত্র মনে করা হয়, তাই তাদের বাড়ি থেকে দূরে কোনো এক জঙ্গল বা নির্জন জায়গায় একটি কুড়ে ঘরে রাখা হয়। যা একরকম নির্বাসনের মত। এমন কি তাদের টিউবয়েল, খাবার পাত্রসহ প্রয়োজনীয় জিনিষ পর্যন্তও ধরতে দেয়া হয়না। এতে দেবতা অসন্তুষ্ট হবেন। এর ফলে গত মাসেও এক কিশোরী মারা গেছে। এই প্রথার কারণে, প্রতি বছরই এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
দেশটিতে ২০০৫ সাল থেকে এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে বেআইনি ঘোষণা করা হলেও, এখনো অনেক সমাজে তা প্রচলিত। তবে এবার যে আইন হলো তাতে কোনো নারীকে ‘ছাউপাদি’ করতে বাধ্য করা হলে ৩০০০ রুপি যা বাংলাদেশি টাকায় দাঁড়ায় ২৩৭৪ টাকা জরিমানা করা হবে, অথবা তিন মাসের কারদণ্ড, অথবা উভয় দণ্ড প্রদান করা হবে।
তবে এই আইনের ফলে সমাজে কেমন প্রভাব পড়বে তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। দেশটির জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার সদস্য মহন আনসারি আল জাজিরাকে বলেছেন, এমন আইন করার জন্য অনেক আগ থেকেই আমরা সরকারকে চাপ দিচ্ছিলাম। এটা আমাদের সমাজের জন্য ‘বড় অর্জন’।
‘এ আইনটি সমাজে নারীদের বাইরে রাখার যে প্রথা তা কমিয়ে দেবে। কারণ, যারা নারীদের এটা করতে বাধ্য করবে তাদের সাজা দেয়া হবে।’
অপরদিকে, নারী আন্দোলনের কর্মী পেমা লাকি এটাকে একটি লঘূ আইন বলেই মনে করছেন কারণ, ‘এই প্রথাটি তাদের অনেক পুরনো যা পরিবর্তন করতে এই আইন দিয়ে সম্ভব নয়। কঠিন আইন প্রয়োগের পক্ষে পেমা লাকি।
বার্তা সংস্থা এএফপি-কে পেমা বলেন, ‘আইনটি নারীদের সঙ্গে এক ধরণের প্রতারণা কারণ, পুরুষ শাসিত নেপালে নারীদের অনুকূলে আইন করা কঠিন। এর জন্য আরো কয়েক প্রজন্ম অপেক্ষা করতে হবে।
দেশটির পশ্চিম এলাকায় ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম ঢাংগাদি। এখানকার বাড়িগুলো মাটি ও খড় দিয়ে তৈরি। এখানকার গ্রামগুলোর প্রায় সব পরিবারই ছাউপাদি প্রথা পালন করে।
প্রথা অনুযায়ী নারীকে একই কাপড় পরে চারদিন ধরে কাটাতে হয়। ওই সময় কোনও পুরুষকে স্পর্শ করা যাবে না এবং বিশেষ কিছু খাবার খেতেও বারণ।
এরপর ৬ষ্ঠ কিংবা ৭ম দিনে গরুর মূত্র দিয়ে গায়ে ছিটিয়ে তাদের ঘরে তোলা হয়। এতে ‘অপবিত্রতা’ দূর হল বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
লহ্মীমালা নামে স্থানীয় এক স্বাস্থ্যকর্মী জানান, তার নিজের বেলাতেও এমনটি ঘটেছে। তবে এখন তিনি এ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার। এখানকার পরিবারগুলোকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন।
লহ্মী বলেন, আমরা দরজায় দরজায় গিয়ে অনুরোধ করে বলছি, আপনার মেয়েকে বাড়ির বাইরে থাকতে বাধ্য করবেন না। তাদেরকে এ সময়টায় ঘরের ভেতর তাকতে দিন। কিন্তু এটা খুবিই কঠিন কাজ। লোকজন আমাদের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। অভিশাপও দেয়। বেশিরভাগ সময় পুলিশ সাথে নিয়ে গ্রামগুলোতে ঢুকতে হয়।
তার পরিবারের এখন আর এর চর্চা করা হয়না। তার নিজের মেয়েকে ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে বাড়িতে নিজের কক্ষেই থাকতে দেন।
যেখানে ওই নারীদের ‘নির্বাসন’ দেয়া হয়। এসব ঘর সাধারণত মাটির। ঘরে প্রবেশের দরোজা এতই ছোট যে হাতে-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। কোনও কপাট নেই।
ওই নারীদের নিরাপত্তার জন্য শীতের সময় একটি মশারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। তবে অন্যসময় খোলাই থাকে। রাতে স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মীরা টহল দেয় আর কুকুর ঘোরাফেরা করে। ফলে এটা নিরাপদ।
শহরাঞ্চলে এখন মেয়েদের কাছে স্যানিটারি প্যাড পরিচিত হলেও, এখানকার মেয়েরা ঋতুস্রাবের সময় পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। স্যানিটারি প্যাড কেনার মত টাকা তাদের হাতে নেই। সূত্র: আল জাজিরা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন