একজন সুরেশ ও মুরাদনগরের ৪শ বছরের জমিদার বাড়ির কথা
কুমিল্লার মুরাদনগরের জাহাপুর ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি নিবাসী জাহাপুর কমলাকান্ত একাডেমী ও কলেজের সহকারী অধ্যাপক বাবু অঞ্জন কুমার রায় এর পিতা বাবু সুরেশ চন্দ্র রায় স¤প্রতি পরলোক গমন করেছেন। ৪০০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত জমিদার বাড়িটি তিনি দেখাশোনা করতেন।তিনি ছিলেন জমিদার বংশের ১১তম বংশধর।
হাতিশালায় হাতি নেই,আাস্তাবলে ঘোড়া নেই, সিংহ দরজায় সিংহ নেই। এখন দালানগুলোই শুধু স্মৃতি বহন করছে ৪০০ বছর পূর্বের এই বাড়িটির; এটি একটি জমিদার বাড়ি। কুমিল্লার মুরাদনগরের জাহাপুরে এর অবস্থান। গোমতি বিধৌত এই জাহাপুর । এই গোমতির কুল কুল ঢেউয়ের তালে তালে এক সময় বয়ে চলত জমিদারদের ”গয়না “নৌকা। তাদের ব্যাপারে বাংলার বার ভূইয়ার এক ভূইয়া কেঁদার রায় নাকি বলেছিলেন -“মেঘনার পূর্ব পাড়ে কোন বড় জমিদার নেই। শাকের মধ্যে লবনতুল্য আছে জাহাপুরের জমিদারগন। জমিদার বাড়িতে পৌঁছেই দেখবেন মুখা মুখি অবস্থানে রয়েছে দুটি সিংহ।তারা অপনাকে এ বাড়িতে নিঃশব্দে স্বাগত জানাবে।প্রধান ফটকে সবসময় দুজন রক্ষী থাকত। জমিদারি আমলে এলে এখানে আপনার পরিচয় দিয়ে ঢুকতে হতো।এখন আর সেদিন নেই। রাইফেল অথবা তীর ধনুক হাতে মাথায় পাগড়ী নিয়ে কোন শিখকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন না। বহিরাঙ্গন এবং অন্দরমহল তারাই দেখতেন। আপনাকে মূল গেটে দেখে হয়তো কেউ এগিয়ে আসবেন। তিনি আপনাকে মুল বাড়িতে নিয়ে যাবেন।
প্রথম বিল্ডিংটি তিন তলা। পুরোটাই ইট-সুড়কি দিয়ে নির্মিত। এরকম আরও ৯টি বিল্ডিং ছিল। ২টি সম্পুর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু জড়াজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাকীগূলো ভাল। ১ম টি বাদে বাকি সবগুলে দোতলা। প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করেই একটি মন্দির দেখতে পাবেন।এটি নাট মন্দির ।দুর্গা পুজার সময় এখানে ভক্তরা সমবেত হন।পাশেই রয়েছে দুর্গাদেবির প্রতিমা।প্রতিমাটি স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এখান থেকে সোজা চলে যাবেন অন্দরমহলে। এ মহলেই বর্তমান বংশধররা বসবাস করছেন। এখানে দেখা হবে ১১তম বংশধর শ্রী আশীষ কুমার রায় ,সমরেন্দ্র রায়,ও অজিত কুমার রায়ের সাথে। এছাড়া রয়েছেন প্রফেসর অঞ্জন কুমার রায়, অধ্যক্ষ রঞ্জন কুমার রায় ও তাদের পরিবারবর্গ। তারাই বর্তমানে এই বিশাল বাড়িটি দেখাশুনা করছেন। আপনার চোখের সামনের ভবনটির দরজার ওপরে খোদাই করা (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ) লিখাটি দেখবেন। এটি তৈরি করেছন অঞ্জন কুমার রায়ের দাদা অশ্বিনি কুমার রায়। এটি জমিদার বাড়ির সর্বশেষ ভবন।এর সামনে প্রশস্ত বরান্দা রয়েছে। ফ্লোর থেকে ছাঁদের উচ্চতা ১৪ ফুট। ছাঁদের নীচের অংশে কাঠের এবং লোহার তৈরি কারুকার্যময় সিলিং দেখতে পাবেন।
এ বাড়িটির বয়স ৪ শ বছর হলেও তাদের জমিদারির বয়স দেড়শ বছর। জমিদারি লাভের পুর্বেই তারা প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক ছিলেন। তারা দেশের বিভিন্ন যায়গায় পাটের ব্যবসা করতেন।১৮৬২ সালে এ বংশের লোকেরা জমিদারি লাভ করেন। জমিদারি শুরু করেন গৌরি মোহন। তার ভাই রাম দয়াল ও কমলা কান্ত তাকে সহযোগিতা করেন। তাদের আওতাধীন বর্তমান তিতাস, মুরাদনগর, দাউদকান্দি, চান্দিনা, দেবিদ্ধার ও নবীনগরে বিস্তৃত ছিল। বাড়ির বাইরের অংশের একটি ঘরে উচু রথ রয়েছে। জমিদারদের ব্যবহৃত সৌখিণ খাট, নকশা করা চেয়ার, গাঁ এলিয়ে দেয়া ঈজি চেয়ার,কারুকার্যখচিত ফুলদানী রয়েছে। এখানও আয়না মহল রয়েছে। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাচ গানের আসর বসত।ওই সময় ব্যবহৃত দু/একটি হ্যাজাক লাইট এখনও রয়েছে। জমিদার গিরিশ চন্দ্র রায়ের পুত্র হেম চন্দ্র রায় সংস্কৃতিবান ছিলেন।তার আমলে জলসা ঘরে বড় ধরনের সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠান হতো।এলাকার লোকজনের চিত্ত বিনোদনের জন্য তিনি যাত্রা গান পালা গান কবি গানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন।
বর্তমানে আমরা পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ফিল্টার ব্যবহার করি।আজ থেকে ১শ বছর পুর্বেও জমিদারগন যে কতটা স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন তা দরজার পাশে রাখা ফিল্টারটির দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। ফিল্টারটির নীচের অংশে চোখ নিলে দেখতে পাবেন ছোট্ট করে লিখা রয়েছে”মেইড ইন লন্ডন”। একটি ছাতা রয়েছে। তবে এটি যেন-তেন ছাতা নয়,রুপার হাতলের ছাতা। জমিদার বাবুরা যখন প্রজাদের সুখ-দুখ দেখার জন্য বের হতেন তখন দুজন লোক এটি বয়ে বেড়াত। এক সময় এবাড়িতে বহু ভক্ত এখানে আসত । তাদের জন্য ফ্রি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। তাদের জন্য রান্না করা ভাতের মার ফেলতে ফেলতে এ যায়গাটি গর্ত হয়ে পুকুরটির সৃস্টি হয়েছে। জাহাপুরের জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু রাস্তা ,ব্রিজ-কালভার্ট, মাদ্রাসা, হাইস্কুল, পোস্ট অফিস ও দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে উঠেছে। জমিদারদের উত্তরসুরি প্রফসর অঞ্জন কুমার রায় বলেন- বিরাট এ জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যক্তিগতবাবে চেষ্টা চলছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন