এটাই কি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দল?
প্রশ্নটার একটাই উত্তর হওয়ার কথা। ওয়ানডে র্যাঙ্কিং চালু হওয়ার পর বেশির ভাগ সময় যে বাংলাদেশ ১০ দলের মধ্যে ১০ নম্বর হয়ে থেকেছে, সেই বাংলাদেশই এখন র্যাঙ্কিংয়ের ৬ নম্বরে। একসময় বাংলাদেশের কাছে জিম্বাবুয়েও ছিল অজেয় এক শক্তি। সেখান থেকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মৃত্যু হয়েছে আজ অনেক দিন। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজও এখন বাংলাদেশের নিচে। দুই বছর আগেও যা ছিল রীতিমতো অভাবিত। আমরা যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটের হাঁটি হাঁটি পা পা যুগের সাক্ষী, তাদের তো গায়ে চিমটি কেটে দেখার মতো অবস্থা! এটা সত্যি তো, নাকি কোনো মায়াবী বিভ্রম! এই দলকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা বলতে দুবার ভাবতে হয় নাকি!
তামিম ইকবাল শুধু দুবার না, অনেকবার ভাবছেন। ভেবে যা বলছেন, তা একটু অবাক করার মতোই। ‘সেরা দল’-এর আলোচনাটাই নাকি তাঁর কাছে অকারণ বলে মনে হচ্ছে। ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন দলের মধ্যে তুলনা করতেই যে রাজি নন বাংলাদেশের ক্রম–উত্তরণের অন্যতম কুশীলব, ‘আমরাই সেরা দল…এই কথাটাই আমি বলতে চাই না। ২০০৫ সালে যে দলটা ছিল, ২০০৭ সালের যে দল, ওগুলোও তো ওই সময়ের সেরা দল ছিল। একেকটা দলের একেকটা লক্ষ্য ছিল, একেকটা স্বপ্ন ছিল। আমি তাই তুলনাতেই যেতে চাই না।’
ব্যাটিংয়ের মতো তামিমের কথাবার্তাতেও এখন অনেক পরিণত বোধের পরিচয়। কেউ যদি এতে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার প্রভাব দেখেন, সেটি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ক্রিকেট নিয়ে, জীবন নিয়ে মাশরাফির শিষ্যত্ব তো তামিম প্রকাশ্যেই স্বীকার করেন। তা এখানে মাশরাফি আসছেন কেন? আসছেন, কারণ মাশরাফি তাঁর দলের প্রশংসা শুনলেই মনে করিয়ে দেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটের এতটা পথ হেঁটে আসা শুধু তাঁদের নিজেদের কৃতিত্বে নয়, অনেকের শ্রম-ঘাম-কষ্ট মিশে আছে এতে। একটা সময় বালতিতে করে পানি এনে খেয়েছেন ক্রিকেটাররা। আকরাম-আমিনুলদের সময়েও দলে নিয়মিত কোনো ফিজিও ছিলেন না। কোনো ম্যাচ ফি ছিল না। তখন তাঁরা খেলে না গেলে কি বাংলাদেশ আজকের এই অবস্থানে আসতে পারত?
খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। যেটিতে মিশে আছে গভীর উপলব্দিও। তামিম ইকবালের কথা শুনে এ কারণেই মনে হলো, তিনি মাশরাফি বিন মুর্তজার ভাবশিষ্য। তবে এমনও তো হতেই পারে যে, দুজনের ভাবনাটা কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে। তা কী বলছেন তামিম? মাশরাফির কথাগুলোই। সঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সব কৃতিত্বই বর্তমান কোচিং স্টাফকে দিলে অন্যায় হবে, ‘এটা এক দিনে হয়নি। কেউ যদি বলে শুধু গত দুই বছরে, তাও না। এর আগে যে কোচরা ছিলেন, তাঁদেরও এতে অবদান আছে।’
সাকিব আল হাসান দাবি করছেন, ২০০৭ সালেই তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ ১০ বছরের মধ্যে ৫/৬ নম্বরে উঠবে। তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমও নাকি একই কথা বলেছিলেন। সাকিব কোথাও বলে থাকতে পারেন। ঠিক মনে পড়ছে না। শুধু এটা মনে আছে, ২০১০ সালে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ১০ বছর পূর্তিতে প্রথম আলো থেকে বের হওয়া বিশেষ ম্যাগাজিনের জন্য দেওয়া ‘দশ বছর পর’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশকে ৫/৬ নম্বরে দেখার আশা করেছিলেন। তবে সেখানে প্রসঙ্গটা ছিল টেস্ট ক্রিকেট। ওয়ানডে নয়।
২০০৭ মানে তামিম ইকবাল তখন মাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছেন। সাকিব ও মুশফিকের ওয়ানডে অভিষেক এর আগের বছরে। তখনই যদি তাঁরা এত বড় স্বপ্ন দেখে থাকেন, সেটি অনেক বড় সাহসের পরিচয়। তামিম অবশ্য সেই সময়ে এমন কিছু বলেছেন বলে ঠিক মনে করতে পারলেন না। তিনি বরং বলছেন, ‘ন্যাশনাল টিমে এসেই ৫/৬ নম্বরের কথা ভেবেছিলাম বললে ভুল হবে। তখন দলের আবহটা অন্য ছিল। লক্ষ্যও ছিল ভিন্ন। আমাদের চাওয়া ছিল একটাই—অন্য দলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারা। তিন–চার বছর যাওয়ার পর আমাদের মধ্যে এই বিশ্বাসটা জন্মায়। কবে ঠিক মনে নেই, একটা টিম মিটিংয়ে আমরা ৫/৬ নম্বরে ওঠা নিয়ে আলাপ করেছিলাম। বলতে পারেন, সেদিন থেকেই আমরা এই স্বপ্নটাকে তাড়া করছি।’
সেই স্বপ্ন তাড়া করে সেটিকে ধরতেও পেরেছে বাংলাদেশ। মুশফিকের কাছে যেটি ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার পুরস্কার, ‘আমরা যে ৬ নম্বরে উঠেছি, এটা তো একটা–দুইটা সিরিজ ভালো খেলার ব্যাপার নয়। আমরা দুই–তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলছি বলেই এটি হয়েছে। এ কারণেই এটা বেশি আনন্দের।’ সেই আনন্দটা এমনই যে, ৬ নম্বরে ওঠার দিনটাকে বলছেন তাঁর ক্যারিয়ারের ‘সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত’।
বাংলাদেশের শুরুর দিনগুলোতে শ্রীলঙ্কার উদাহরণটা খুব দেওয়া হতো। যদিও তখন মিল যত ছিল, অমিল ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। অবশেষে বড় একটা মিল কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল বেশ কজন খেলোয়াড়ের অনেক দিন একসঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাতেও মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ—এই অভিজ্ঞ পঞ্চকের বড় ভূমিকা। মুশফিক অবশ্য দলে আসা তরুণদেরও অবদানকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে চান, ‘আমাদের দলে এখন ৭–৮ জন নিয়মিত পারফরমার আছে। তরুণেরাও ম্যাচ জেতাচ্ছে। দল এখন আর এক–দুইজনের ওপর নির্ভরশীল নয়। আমরা সিনিয়রটা জানি, আমরা ভুল করলেও ওদের কেউ ঠিকই দাঁড়িয়ে যাবে। এটা আমাদের ওপর চাপটা অনেক কমিয়ে দিয়েছে।’
এই তরুণরা অন্য মানসিকতায় গড়া এবং সেটিই স্বাভাবিক। সাব্বির-মোস্তাফিজ-সৌম্য-মিরাজরা যখন ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছেন, বাংলাদেশের জয় আর আগের মতো ‘ঈদ’ নয়, যে আনন্দ বছরে সর্বোচ্চ দুবার পাওয়া যায়। সেটি প্রায় নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত। দলে এসেই তাঁরা তাই ভিন্ন একটা আবহ পেয়েছেন। তামিম ইকবাল দুই যুগের পার্থক্যটা খুব ভালো বললেন, ‘আমরা যখন দলে এসেছিলাম, একটা ম্যাচ জিততে চাইতাম। ওরা এসে দেখেছে, আমরা সিরিজ জিততে চাই। দলের আবহটাই আলাদা। ওরা সবাই জানে, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সই সব না, আমরা দল হিসাবে সাফল্য চাই। আরেকটা বড় পার্থক্য হলো, আমরা এসেছিলাম তরুণ এক দলে। দুই–তিনজন ছিল, যাঁরা ৮০–৯০টা ম্যাচ খেলেছে। আর এই দলে আমি, সাকিব, মুশফিক তিনজনই প্রায় দুই শর মতো ম্যাচ খেলে ফেলেছি। মাশরাফি ভাইও তা-ই। সব কিছু মিলিয়েই পরিবর্তনটা হয়েছে।’
তা হতে কম সময় লাগেনি। একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশ খেলতে নামার আগেই ম্যাচের ফলটা সবার জানা হয়ে যেত। চাওয়া ছিল একটাই, বাংলাদেশ তো হারবেই, একটু যেন লড়াই করে হারে। কী সময়ই না গেছে! ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর টানা ৪৭টি ম্যাচে জয় কী বস্তু, তা জানা হয়নি বাংলাদেশের। এই ৪৭ ম্যাচের যে দুটিতে পরাজয় এড়ানো গিয়েছিল, তা ছিল বৃষ্টির আশীর্বাদ। প্রায় পাঁচ বছরের সেই ঘোর অমানিশায় প্রথম আলোর রেখা হাবিবুল বাশার-ডেভ হোয়াটমোর জমানায়। ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় দিয়ে শেষ হলো দীর্ঘ জয়খরা। সে বছরের ডিসেম্বরেই ভারতকে হারিয়ে টেস্ট স্ট্যাটাস উত্তর যুগে প্রথম বড় জয়। মাস ছয়েক পরই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই কার্ডিফ মহাকাব্য। ২০০৬ সালে শ্রীলঙ্কা, পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে দুই বড় শিকার ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এর সবই হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে।
সেই হাবিবুল বাশার একটি ভারতীয় টিভি চ্যানেলে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করতে লন্ডন এসেছেন। ঢাকা-লন্ডন ফ্লাইটে প্রায় সাড়ে ১০ ঘণ্টা তাঁর যাত্রাসঙ্গী। কথায় কথায় বাংলাদেশের র্যাঙ্কিংয়ে ৬ নম্বরে ওঠার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে যে জবাবটা পেলাম, তা একটু স্তব্ধই করে দিল। ‘১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে এশীয় যুব ক্রিকেট হয়েছিল। আমার এখনো মনে পড়ে, ভারতের বিপক্ষে আমরা যখন ব্যাটিং করছিলাম, ওরা খুব হাসছিল।’ হাবিবুলের যন্ত্রণাকাতর মুখ দেখে মনে হলো, যেন টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে গেছেন ২৮ বছর আগের ময়মনসিংহ স্টেডিয়ামে।
না, তামিম ঠিকই বলেছেন। র্যাঙ্কিংয়ের ৬ নম্বরে ওঠা এই দলটিকে ‘বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা’ বলে দেওয়া খুবই সহজ। কিন্তু তাতে অনেক কিছু বলা হয় না। অনেক কষ্ট, অনেক অপমান, অনেক লড়াই…। অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশের জয়যাত্রার সূচনা করেও এত বছরে যা ভুলতে পারেননি হাবিবুল বাশার।-প্রথম আলো
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন