এবারও বর্ষা মৌসুমে ডুববে ঢাকা?
গত জুলাই মাসে ভারি বৃষ্টিতে ঢাকা ভাসলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ‘প্রমিজ’ করে বলেছিলেন, আর জলাবদ্ধতা হবে না। এরপর নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করে ওয়াসা ৬০ কোটি টাকা অনুদান চায় স্থানীয় সরকার বিভাগ ও অর্থ বিভাগের কাছে। বহু বছর ধরে ঢাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য ওয়াসা মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা করে বরাদ্দ পাচ্ছে। হঠাৎ প্রায় ১১ গুণ বেশি টাকা চাওয়ায় ওয়াসার কাছে ব্যাখ্যা চায় বিভাগ দুটি। গত ২৪ জানুয়ারি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাসকিম এ খান স্বাক্ষরিত ব্যাখ্যা মন্ত্রণালয় দুটির সচিবদের কাছে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, পরিকল্পিত কাজগুলো আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে সম্পন্ন করার জন্য এ মুহূর্তেই দরপত্রপ্রক্রিয়া শুরু করা জরুরি। ওয়াসা তাৎক্ষণিক কাজ শুরু করার কথা বললেও এরপর আরো এক মাস পেরিয়ে গেছে, অর্থপ্রাপ্তি নিয়ে সমাধান আসেনি।
এদিকে সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসাসসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর আইন যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আট সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি করে দিয়েছিল আগস্টে। এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু দেওয়া হয়নি গত সাত মাসেও। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এভাবে সময় নষ্ট হলে অদূর ভবিষ্যতেও সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা দেখা দেবে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ শহরের জলাবদ্ধতার সমাধানের লক্ষ্যে গত বছরের ১ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সভাপতিত্বে এক সভায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পাস) নাসরিন আকতারকে প্রধান আর উপসচিবকে (পাস-২) সদস্যসচিব করে আট সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির দায়িত্ব ছিল বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে সিটি করপোরেশন ও ওয়াসাগুলোর বিদ্যমান আইন পর্যালোচনা করে যুগোপযোগীকরণের লক্ষ্যে কাজ করা। এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিলেন মন্ত্রী, যা মানা হয়নি।
এদিকে ওয়াসার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৫টি খাল পুনঃখনন, বেশ কিছু বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করা, বিভিন্ন ইউ চ্যানেল পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিয়ে সরকারের কাছে ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে ওয়াসা পায়নি। কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এখনই দরপত্র আহ্বান করা সম্ভব না হলে আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। এর আগে ২০১৬ সালে ঢাকার পানি নিষ্কাশন কার্যক্রমের জন্য ওয়াসা ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েও পায়নি।
ওয়াসার চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসা ড্রেনেজ খাতে কোনো রাজস্ব পায় না। পানি ও পয়ঃখাতে অর্জিত অর্থ থেকে টাকা খরচ করে ড্রেনেজ সচল রাখা হচ্ছে। বহু বছর আগে থেকে বছরে মাত্র পাঁচ কোটি ৫০ লাখ টাকা পায় নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারি অনুদান হিসেবে, যা দিয়ে ড্রেনেজ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ওয়াসা এ খাতে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল, পাওয়া যায়নি।
এবার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া প্রসঙ্গে চিঠিতে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ খরচ ও মহানগরীর আয়তন এবং জনসংখ্যা বাড়ার কারণে অতিরিক্ত ৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কাজগুলো আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে সম্পন্ন করার জন্য এ মুহূর্তেই দরপত্রপ্রক্রিয়া শুরু করা জরুরি।
ঢাকায় জলাবদ্ধতার কারণ ব্যাখ্যা করে ওয়াসা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, পানি নিষ্কাশনের জন্য ওয়াসা ৭৪ কিলোমিটার খাল রক্ষণাবেক্ষণ করে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত কঠিন বর্জ্য, নির্মাণসামগ্রী এবং নির্মাণ বর্জ্যসহ অন্যান্য বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলার কারণে খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। ভাসমান কঠিন বর্জ্য অপসারণের পর দু-একদিনের মধ্যেই খাল আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আগে খালগুলো নগরীর ভেতর দিয়ে বিভিন্ন জলাশয়ের মধ্য দিয়ে নদীতে গিয়ে মিশত এবং জলাশয়গুলোও জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মহানগরীর জলাশয়গুলো ভরাট করে বসতি ও নগরায়ণ হওয়ার কারণে মহানগরীতে জলাধারের পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে খালগুলোও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভরাট হয়ে গেছে। তা ছাড়া খালগুলো বহুদিন ধরে পুনঃখনন করা হয়নি। চিঠিতে জোর দিয়ে বলা হয়, ‘নদীর আউটলেট থেকে আপস্ট্রিম পর্যন্ত খালগুলো খনন করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ খালের পাশে এক্সকাভেটর আনা-নেওয়ার রাস্তা না থাকায় খালগুলো খননের জন্য অ্যাম্ফিবিয়াস এক্সকাভেটর তথা উভচর খনন যন্ত্র ও ফ্লটিং (ভাসমান) বুলডোজার কিনতে চায় ওয়াসা।’ ময়লা অপসারণের জন্য পর্যাপ্ত ডাম্প ট্রাক না থাকার কথাও চিঠিতে বলা হয়েছে।
আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই ঢাকা ওয়াসা যেসব খাল-বিল পুনঃখনন করতে চায় এর মধ্যে রয়েছে শাহজাদপুর বিল, জিরানী খাল, সেগুনবাগিচা খাল, দেব-ধোলাই খাল, মাণ্ডা খাল, কসাইবাড়ী খাল, বেগুনবাড়ী খাল, হাজারীবাগ খাল, কল্যাণপুর খাল শাখা ‘ঘ’, ইব্রাহীমপুর খাল, রূপনগর শাখা খালগুলো, রূপনগর প্রধান খাল, বাউনিয়া খাল ও কাটাসুর খাল। এ ছাড়া খিলগাঁও, বাসাবো ইউ চ্যানেল, শাহজাদপুর ইউ চ্যানেল, মহাখালী ইউ চ্যানেল, রামচন্দ্রপুর খাল পরিষ্কার করা এবং সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করা, মহাখালী বক্স কালভার্টে মধ্যবর্তী ১২টি ম্যানহোল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা।
ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতে ওয়াসার আওতায় ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট রয়েছে। এসব বক্স কালভার্ট সচল রাখতে স্ক্যাপার, এক্সকাভেটর ও ডাম্প ট্রাক ব্যবহার করা ছাড়াও মধ্যবর্তী ম্যানহোল নির্মাণ করা হবে। ব্যস্ত রাস্তায় বিদ্যমান বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করা খুবই জটিল, ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। অনিয়ন্ত্রিত কঠিন বর্জ্য, নির্মাণ সামগ্রী ও নির্মাণ বর্জ্যের কারণে পাইপ ড্রেন, খাল ও বক্স কালভার্টগুলো চালু রাখার জন্য সব সময় পরিষ্কার করা প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া ঢাকা ওয়াসার ৩৬০ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন রয়েছে। গত কয়েক বছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্মাণ করা ড্রেনেজগুলোও ওয়াসার ড্রেনেজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ফলে ওয়াসার ড্রেনেজে প্রচুর পরিমাণ বালু ও মাটি ঢুকেছে। রাস্তায় কার্পেটিংয়ের পর আবার কার্পেটিং করার কারণে ম্যানহোলগুলো ঢেকে গেছে, ক্যাচপিট তথা পানি নামার ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই ক্যাচপিট নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
ওয়াসা জানিয়েছে, ওয়াসার আওতাধীন চারটি বড় পাম্পিং স্টেশনের মধ্যে ধোলাইখাল পাম্পিং স্টেশন চালু রাখার জন্য একটি ‘ফ্রিকোয়েন্সি কনভার্টার’ জরুরি ভিত্তিতে সংগ্রহ করা দরকার। এ ছাড়া আরো একটি ফ্রিকোয়েন্সি কনভার্টার রাখা দরকার আপৎকালের জন্য। পাম্পিং স্টেশনগুলোতে থাকা ১৬টি পাম্প সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বড় ধরনের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
এদিকে সাত মাসেও প্রতিবেদন জমা দিতে না পারার কথা স্বীকার করে কমিটির সদস্য ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, আইন অনুযায়ী বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ওয়াসার। একপর্যায়ে মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে আরো স্পষ্ট হওয়ার জন্য একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এখনো প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।’
বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে কমিটির সদস্যসচিব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পাস-২) কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘আইনসংক্রান্ত কিছু জটিলতায় একটু সময় লেগে গেছে। আমাদের কমিটির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আর বেশি সময় লাগার কথা না। খুব দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে পারব বলে আশা করছি।’
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন), ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন বসন্তকাল। এরপর গ্রীষ্ম পেরোলেই বর্ষাকাল। কিন্তু যেসব কারণে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে সামান্য বৃষ্টিতেই, সেগুলোর কোনোটাই দূর হয়নি। ফলে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে বর্ষণে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা দেখা দিলে এর দায় নিয়ে আবারও রশি টানাটানি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন