এবার লাশের বাণিজ্যে নেমেছে মিয়ানমার
রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা চালানোয় পুরো বিশ্বে নেতিবাচক দৃষ্টিতে পরিচিত হচ্ছে মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরকারের ওপর নিন্দা প্রস্তাব আনছে একে একে। কঠোর সমালোচনা করছে মিয়ানমার ও দেশটির নোবেল জয়ী নেত্রী অং সান সু চির।
সেই সমালোচনা থেকে কিছুটা মুক্ত হতে নতুন কৌশল করছে মিয়ানমার সরকার। রোহিঙ্গা সঙ্কটকে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মালম্বীদের দ্বন্দ্ব বলে প্রচারণা চালানো শুরু করেছে।
এতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করছে মিয়ানমারের হিন্দুদের লাশ নিয়ে। রোহিঙ্গা নিধনের সময়ে মারা যাওয়া হিন্দুতের একত্র করে গণকবর বানাচ্ছে। সেই ছবি নিয়ে সাংবাদিকদের মিথ্যে তথ্য দিচ্ছে।
এমনি এক ছবির আসল তথ্য উদঘাটন করেছেন মিয়ানমারে কাজ করে বিবিসির এক সাংবাদিক। হিন্দুদের হত্যার একটি ছবি তাকেও দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি খুঁজে পান, ওই হিন্দু পরিবারটি এখন বাংলাদেশর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছেন।
আন্তর্জাতিক কয়েকটি গণমাধ্যম জানায়, পরপর দুই দিনে দুই দফায় হিন্দু গণকবরের সন্ধান পাওয়ার দাবি করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। সরকারের দাবি অনুযায়ী, মুসলিম বিদ্রোহীরা এই হিন্দুদের হত্যা করেছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সংঘাতের মাঝখানে পড়ে যাওয়া নিহত হিন্দুদের মরদেহ এখন প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, কয়েক দিন চলে গেলেও সেগুলোর সৎকার করা হয়নি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারের এই ভূমিকাকে ‘মরদেহের রাজনীতি’ আখ্যা দিয়েছে। আর স্বনামধন্য একজন মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ সাফ জানিয়েছেন, তিনি এসব বিশ্বাস করেন না। উল্টো তিনি প্রশ্ন করেছেন, এত এত রোহিঙ্গার প্রাণহানী হচ্ছে, অথচ তাদের গণকবর পাওয়া যায় না কেন? এইসব ‘প্রচারণা’ কৌশলের সঙ্গে সংযোগ পাওয়া যায়, মিয়ানমার টাইমস-এর সম্পাদকের সাম্প্রতিক এক মন্তব্যের। সত্য প্রকাশ নয়, যে কোনোভাবে মিয়ানমারের ইতিবাচক ভারমূর্তি নির্মাণ করার চেষ্টাকেই তিনি সাংবাদিকতা মনে করছেন।
চলতি সপ্তাহে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ৪৫ জন হিন্দুর লাশ একটি গণকবরে পাওয়ার দাবি করে। এরপর তা মিয়ানমারের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আকারে কাভারেজ পায়। এতে করে দীর্ঘদিন ধরে চলমান ক্ষমতাসীন বৌদ্ধ ও মুসলিমদের সংঘাত নতুন মোড় দেয়।
রোববার(২৪ সেপ্টেম্বর) গণকবরের সন্ধান পেলেও বুধবার(২৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সেগুলোর শেষকৃত্য শেষ করা হয়নি। ওইদিন সেনাবাহিনী ইয়াঙ্গুন থেকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে হিন্দুদের লাশ দেখানোর জন্য নিয়ে যায়। ঘাসের ওপর ছড়িয়ে থাকা হিন্দুদের লাশগুলো দেখানো হয় সাংবাদিকদের। একই সঙ্গে হিন্দুদের ওপর রোহিঙ্গা মুসলিমদের সহিংসতার বর্ণনা দেওয়া হয়।
ঘটনাস্থলে পুলিশ কর্মকর্তা ওক্কার কো বলেন, ‘আমরা এই পাশ থেকে (স্থানীয়) যে তথ্য পাচ্ছি, তা অনুসরণ করছি। যেখানে মাটি অসমতল মনে হচ্ছিল সেখানেই গর্ত খুঁড়তে শুরু করি আমরা। এরপর দুর্গন্ধ পাই।’
২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালালে সর্বশেষ এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে রাখাইন রাজ্যে। মিয়ানমার সরকারের দাবি, এর কয়েকঘণ্টা পরই আরসা সদস্যরা হিন্দুদের গ্রাম ইয়ে বাউ কিয়াতে প্রবেশ করে। তারা গ্রামের শতাধিক মানুষকে জড়ো করে। বন্দুকের মুখে তাদের ধানের ক্ষেতের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ছুরিকাঘাতে হত্যা করে আরসা সদস্যরা।
রাখাইনে সাংবাদিক প্রবেশে বাধানিষেধ থাকায় কোনও সংবাদমাধ্যমের পক্ষে স্বাধীনভাবে ঘটনাটি যাচাই-বাছাই করা যায়নি। তবে বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, আরসার ওপর হিন্দুদের হত্যার দায় চাপিয়ে সরকার বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা নিধন সংক্রান্ত ঘটনার যথাযথ তদন্তে নিজেদের অনাগ্রহকেই প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পোড়া কিংবা ছুরি-বন্দুক কিংবা অন্যকিছু দিয়ে ভয়ঙ্কর জখম করা দেহ, তাদের ওপর যৌন সহিংসতার আলামত বিশ্লেষণ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এরইমধ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের মানবতোবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ এনেছে।
মিয়ানমারকে বার্মা নামে সম্বোধন করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকারের উচিত এর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনতার পাশাপাশি হিন্দু-মুসলিমদেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। নিরাপত্তাজনিত হুমকি মোকাবিলা করা সরকারের দায়িত্ব বটে। তবে আইনের শাসনের সীমার মধ্যে থেকেই তা করা উচিত।
হিন্দুদের হত্যা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)। তাদের দাবি, তারা বেসামরিকদের ওপর কোনও হামলা চালায় না এবং কোনও হিন্দুকেও হত্যাও করেনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর দাবি, মিয়ানমারের মরদেহ নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। সামরিক নৃশংসতার অবসান ঘটিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত দলকে রাখাইনে প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত, যেন সব ধরনের অপরাধের যথাযথ তদন্ত করা যায়।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস-এর গবেষক জারনি। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে সরব ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে সামরিক শাসনের কবল থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এই গবেষক। মিয়ানমার বিষয়ের একজন স্বীকৃত গবেষক তিনি। সেই জারনি বলছেন, ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছেন। ওই সময় থেকেই মুসলিমবিরোধী প্রচারণা জোরদার হয়।
সন্ত্রাসী-জিহাদি পরিচয়গুলো সামনে আসতে থাকে। সাম্প্রতিক সহিংসতা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক হামলা বাকি সবকিছুকে হার মানিয়েছে বলে মনে করেন জারনি। সরকারের প্রচারণাকে বিশ্বাস করেন না তিনি। সম্প্রতি ২৯ জন হিন্দুর মরদেহসহ গণকবরের সন্ধানের সংবাদ নিয়েও অবাক হন তিনি।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সু চিকে সমর্থন দেয়ার পর এমন ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি এগুলো একদমই বিশ্বাস করি না। হাজার হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তাদের মরদেহ কোথায়? তাদের গণকবর কোথায়?’ তিনি বলেন, ‘এই তথ্য মিয়ানমার সরকারের দাবি করা। কোনও স্বাধীন সূত্র থেকে পাওয়া নয়।’
জারনির মতে, মিয়ানমারের উচিত, জাতিসংঘকে ঘটনার তদন্ত করতে দেওয়া। তারাই তদন্ত করে জানাবে। এই গণকবরের বিষয়টির সত্যতা নির্ধারণ করবে।
জারনি জানান, বর্তমানে মিয়ানমারের সামরিক স্কুল থেকে ১০ হাজার সেনা ক্যাডেট প্রশিক্ষিত হয়ে আসছে। জার্নি দাবি করেন, ‘তাদের প্রত্যেককে সামাজিক মাধ্যমে দুই ঘণ্টা করে মুসলিমবিরোধী, রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারণা চালাতে বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষও এর বিরোধিতা করতে পারে না। কারণ, তারা মিথ্যাটাকেই সত্যি মনে করে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন