এ বছর ডেঙ্গুর মাত্রা কি আগের চাইতে তীব্রতর?
বাংলাদেশে প্রতিবছরের মতো এবারও এই সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে – তবে গত তিন মাসে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্তত এগার জনের মৃত্যুকে কিছুটা হলেও অস্বাভাবিক বলে মনে করা হচ্ছে।
যদিও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে একটি গবেষণা চলছে। শিগগিরই গবেষণা প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হবে।
প্রতিষ্ঠানটির একজন পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদি সাব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গুতে যে এগার জনের মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে তাদের মধ্যে কয়েকজন আগেও এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলছেন, একবার আক্রান্ত হলে ওই একই ব্যক্তি যদি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হন – তখন তার ক্ষেত্রে রোগটি বেশি জটিল হতে পারে।
তবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ইতোমধ্যেই বলছেন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সেটি এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। যদিও সরকারি হিসেবে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা গত ছয় মাসে অন্তত তিন হাজার।
ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছে সিটি কর্পোরেশন।
ডেঙ্গু কেন বা কীভাবে হয়?
সাধারণ ভাবে এটা এখন কমবেশি সবারই জানা যে ডেঙ্গু রোগ হয় এক ধরনের ভাইরাস থেকে – যা এডিস মশা দ্বারা ছড়িয়ে থাকে। সাধারণত জমে থাকা পরিষ্কার পানি, ফুলের টব, টায়ার, এয়ারকুলারে জমা পানি থেকে এ মশাটি বিস্তৃতি লাভ করে।
রোগটির প্রাথমিক লক্ষণ হলো জ্বর।
সে কারণেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে বা এডিস মশার বিস্তার লাভে নাগরিকদের সতর্কতার ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নিজ নিজ বাড়িঘর আঙ্গিনায় পরিষ্কার পানি যেনো জমে না থাকে সেজন্য প্রচারণাও চালানো হচ্ছে।
কিন্তু তারপরেও প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। এর কারণ কী?
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তদের দেহে এ রোগের ভাইরাসের চারটি স্ট্রেন বা প্রকার পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এডিস মশা থেকে চার ধরনের ভাইরাস মানব শরীরে আসতে পারে।
“এবার যে ১১ জন মারা গেছে তাদের কয়েকজন এর আগে আক্রান্ত হয়েছিলো। সে কারণে তারা বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে ছিলো।”
তা ছাড়া অন্য কারণ হিসেবে বয়স কিংবা দেরীতে চিকিৎসা নিতে আসার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
ডা: আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলছেন, এডিস মশার ভাইরাস চার ধরণের, যাকে সেরোটাইপ বলা হয়। তবে কোন সেরোটাইপে কে আক্রান্ত হলো, কোন সেরোটাইপের জটিলতা কেমন তা নিয়ে খুব বেশি গবেষণা না থাকায় চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য কর্মীদের কাছে এখনো আলাদা কোনো নির্দেশনা নেই।
অধ্যাপক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, এবার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে আক্রান্তদের দেহ থেকে এবং তার ওপর গবেষণার ফল পাওয়া যাবে শিগগিরই।
এবারের ডেঙ্গুর মাত্রা কেমন? লক্ষণ কি কিছুটা আলাদা?
এবারের ডেঙ্গুর মাত্রাকে খুব বেশি আলাদা বলে উল্লেখ করতে এখনো রাজী নয় আইইডিসিআর। এ বিষয়ে মন্তব্যের ক্ষেত্রে তারা তাদের গবেষণার প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইছে।
তবে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের চিকিৎসকরা তাদের কাছে আসা রোগীর ধরণ কিংবা রোগীদের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বলছেন, এবারের ডেঙ্গুর আক্রান্ত হওয়ার যে ধরণ তাতে একটি বেশি মাত্রা দেখা যাচ্ছে।
ডা: আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলছেন, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে আগে কমন কিছু উপসর্গ ছিলো শরীর ব্যথা, চোখের চারদিকে ব্যথা, গায়ে র্যাশ। কিন্তু এবার এর বাইরেও হাসপাতালে ও ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী পাওয়া যাচ্ছে যারা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত।
“এমনকি অল্প মাত্রার জ্বর পরীক্ষা করেও ডেঙ্গু ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে। তাই জ্বর হলেই সতর্ক হতে হবে। তবে কোনো ব্যথানাশক ঔষধ খাওয়া যাবেনা।”
ডেঙ্গু একবার হলে আবার হয়?
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, এবার যারা মারা গেছেন তাদের কয়েকজন আগেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
অবশ্য আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান বলছেন যে টাইপের এডিস মশায় কামড়ানোর ফলে কারও একবার ডেঙ্গু হয় সেই একই টাইপের ভাইরাস থেকে একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবেনা। তবে এডিস মশার বাকী তিনটি টাইপের ভাইরাস থেকে তিনি আবারো আক্রান্ত হতে পারেন।
ডা: আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলছেন, “ডেঙ্গু একবার হলে আর হবেনা এর কোনো নিশ্চয়তাই নেই। বরং দ্বিতীয় বার হলে তার মাত্রা বেশি হয়। তবে একই টাইপের ভাইরাস থেকে সাধারণত দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হয়না”।
চিকিৎসা কেমন?
ডা: আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। এক দুই দিন পরপর রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা পরীক্ষা করে দেখতে হব। প্লাটিলেট কমে গেলে তাকে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত। আর অন্য যা বৈশিষ্ট্য থাকবে তার ভিত্তিতেই চিকিৎসা করবেন চিকিৎসকরা। তবে ব্যথানাশক কোন কিছু কেউ যেনো গ্রহণ না করে যদি ডেঙ্গু হয়ে থাকে।
তিনি জানান বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের রোগীদের মধ্যে এবার ইয়াং পুরুষ রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তবে গর্ভবতী নারীদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কয়েকটি ঘটনাও পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে ২০০০-২০০১ সালের দিকে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর মশাবাহিত এই রোগটি নির্মূলে মশা নিধনসহ বেশ কিছু সচেতনামূলক পদক্ষেপ নেওয়ায় তার প্রকোপ কিছুটা কমে এসেছিলো।
যদিও ২০১৫ সালে আবার তা বেড়ে যায়।
এবছরও এতে আক্রান্ত লোকের সংখ্য বাড়ছে তাই মশাবাহিত এই রোগটির বাহক মশা নিধনে কতটা কাজ হচ্ছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
-বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন