সাতক্ষীরার কলারোয়ায়

করোনা-লকডাউনের চেয়ে এনজিও’র চাপে বিপাকে অনেকে

‘মালয়েশিয়া থেকে অপরিচিত একজনের ফোন। অপরপ্রান্ত থেকে বললেন তার বাড়ি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কুশোডাঙ্গা ইউনিয়নে। জানালেন, মালয়েশিয়ার যেখানে থাকেন সেখানে কঠিন লকডাউন চলছে, বাইরে যাওয়া নিষেধ, ঘরেই অবস্থান করছেন। বেশ কিছুদিন কাজ বন্ধ, আয়-রোজগার নেই। তাই বাড়িতেও টাকা পাঠাতে পারেন নি। এরই মধ্যে কুশোডাঙ্গায় তার গ্রামের বাড়িতে স্বজনদের কাছে এনজিও কর্মীরা এসে ঋণের কিস্তির জন্য চাপ দিচ্ছেন।’
অনুরোধ করলেন, ‘কিস্তি তো দেবো তবে একটু সময় দিতেই হবে। একটু লেখালেখি করেন, তাতে যদি কাজ হয়।’

কলারোয়ায় করোনা আর লকডাউনের চেয়ে এনজিও’র চাপে বিপাকে অনেকে- এমনটাই বলছেন ভুক্তভোগিরা। মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষিতে চলমান লকডাউনে প্রায় সকলেই বিপর্যস্ত। কেউ আর্থিক, কেউ শারীরিক, কেউ মানসিক, কেউ সামাজিক আবার কেউ অন্যভাবেও। এমন কেউ নেই যে করোনার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভালো আছেন। ব্যবসা বানিজ্য কিংবা অর্থনৈতিক সংস্থান ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে প্রায় সকলের। লকডাউনের কারণে সিংহভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ। সীমিত সময়ের জন্য কিছু দোকান খোলার সুযোগ থাকলেও সেটাও অপ্রতূল। এর মধ্যে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে এনজিও’দের কিস্তি আদায়।

ফলে চরম বিপাকে পড়ছেন দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের ঋণ গ্রহীতারা। এনজিওকর্মীরা লকডাউনের মধ্যে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে কিস্তি আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঋণের কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন উপজেলার সংশ্লিষ্ট সাধারণ জনগণ।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর থেকে নিবন্ধনের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে এনজিও এবং নানান সমিতি। এসকল এনজিও এবং সমিতি সঞ্চয় ও ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। করোনা আর লকডাউনের এই সময়েও ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়মিত কিস্তি আদায় করে চলেছেন তারা। অনৈতিক, অবিবেচক আর অমানবিক ভাবে চড়া সুদে ঋণের কিস্তি আদায়ের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এনজিও এবং সমিতির মাঠকর্মীরা।

ঋণ গ্রহীতা ক্ষুদ্র মুদি ব্যবসায়ী শেখ সাহিদ হাসান বলেন, ‘ব্যাংকের নানান বিধি-নিষেধ ও নিয়ম থাকায় সাধারণত ছোটখাটো ব্যবসায়ী ও নিন্ম আয়ের মানুষজন এনজিও এর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। অনেকে এনজিও’র কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ভ্যান, ইজিবাইক কিনে সেটা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। লকাডাউনে ওই সকল যান চলাচল কমে গেছে, আমাদের মতো ক্ষুদ্র দোকানদারদের বেচাকেনাও ব্যাপক ধ্বস নেমেছে। আয় কমে গেলেও ব্যয় তো কমেনি। এরই মাঝে এনজিও’র সাপ্তাহিক কিস্তি দিতে আমরা সত্যি চরম হিমশিম খাচ্ছি। টাকা কম কিংবা না দিতে পারলে এনজিও কর্মীদের দুর্ব্যবহার হজম করতে হয়।’
পরিস্থিতি বিবেচনায় আপাতত ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত রাখার আহবান জানিয়েছেন তিনি।

রাজমিস্ত্রি সুকুমার বিশ্বাস, ইজিবাইক চালক শামিম, ভ্যান চালক ভোলা, গৃহিনী কমলাসহ ভুক্তভোগী অনেক ঋণ গ্রহীতারা জানান, ‘তারা বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা, ছোটোখাট গাড়ি কিনে ও অন্যান্য মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে জীবিকা নির্বাহসহ ঋণের কিস্তি দিয়ে আসছি। করোনাকালীন লকডাউনে ব্যবসা বাণিজ্যসহ প্রায় সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। আয়-রোজগার নেই বললেই চলে। ধার দেনা করে সংসার চলছে। কিস্তি কীভাবে দেবো ভেবে পাচ্ছি না।’

লকডাউনের সময় কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান তারা।

গত ১০ জুন লকডাউন চলাকালীন ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আদায় না করার জন্য ফেসবুক আইডি থেকে এনজিও কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন সাতক্ষীরার সদ্য সাবেক জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল। অথচ জেলা প্রশাসকের সেই নির্দেশনা মানছে না এনজিওগুলো। বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে প্রতিদিন সকাল থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিস্তি আদায় করে চলেছেন এনজিও’র মাঠকর্মীরা।

এদিকে, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি ঘুরে বেড়ানোয় ঋণ গ্রহীতা পরিবারগুলোর পাশাপাশি এসব এনজিও’র মাঠকর্মীরাও মহামারী করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানান মাঠ পর্যায়ের একাধিক এনজিও কর্মীরা।

এনজিও কর্মীরা বলেন, ‘অফিসের চাপের মুখে পড়ে বাইরে আসতে হচ্ছে। করোনার এমন দু:সময়ে উপজেলার ভুক্তভোগী খেটেখাওয়া ঋণগ্রহীতারা যখন তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন, তখন আমরা (এনজিওকর্মীরা) বাড়ি বাড়ি কিস্তি আদায়ের জন্য ধন্না দিচ্ছি। কীভাবে তারা কিস্তি দিবে? কেউ গালিগালাজ করছে, কেউ পালাচ্ছে, কেউ কাঁদছে। আমরা পড়ে গেছি মহা বিপাকে।’

জানা গেছে, কিছুদিন আগে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এর ফেসবুক আইডি হতে জেলার সকল উপজেলা সমূহে চলমান করোনা সংক্রমণ চলমান লকডাউনে সকল এনজিও’র প্রতি কিস্তি আদায়ের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের প্রতি কোন বাধ্যবাধকতা না রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়।
এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হতে এনজিও প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছে চিঠি দিয়ে জানানো হয় যে, মহামারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকটা অচল হয়ে পড়েছে সাধারণ ক্ষেতে খাওয়া মানুষ। এসময় এনজিও হতে লোন নেওয়া মানুষের কাছে কোন রকমের চাপ না দেওয়া অনুরোধ জানানো হয় এবং বলা হয় এনজিও কর্মীরা কিস্তি আদায় করতে যাবে না। কেউ কিস্তির টাকা দিতে চাইলে ফোনের মাধ্যমে প্রদান করবে। এসব নির্দেশনা থাকা সত্বেও লকডাউনের মধ্যে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে কিস্তি আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এনজিওকর্মীরা।

কিস্তি আদায় বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা ব্র্যাক এনজিও’র সম্মনয়কারী মো. আশরাফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের ফেসবুক থেকে দেয়া ঋণ আদায় না করা সংক্রান্ত পোস্টটি আমরা দেখছি। জোর করে কিস্তি আদায় করতে নিষেধ করা হয়েছে। যদি কোন কর্মী অতি উৎসাহী হয়ে কিস্তি আদায় করতে জবরদস্তি করে সেটি তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।’

কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জুবায়ের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘করোনা আর লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকে। কর্মহীন মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন, কষ্ট হচ্ছে তাদের। এমন পরিস্থিতিতে এনজিও’র কিস্তি আদায় বন্ধে প্রাথমিকভাবে তাদের মৌখিক ভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে কথা হয়েছে। তিনি ২/১দিনের মধ্যে এনজিও প্রতিনিধিদের সাথে অফিসিয়ালি বসে চূড়ান্ত নির্দেশনা দেবেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘আসলে এনজিও চলে অন্য অথরিটির অধীনে। তবে স্থানীয় প্রশাসন হিসেবে করোনার প্রেক্ষিতে আপাতত কিস্তি বন্ধের সিদ্ধান্ত তাদের জানিয়েছি।’

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপাতত কিস্তি আদায় বন্ধ রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।