কলরেটে প্রশ্নবিদ্ধ মুনাফা : বিকল্প মাধ্যমে ঝুঁকছেন গ্রাহক
দেশের সব মোবাইল অপারেটরে বর্তমানে অফলাইন-অনলাইন ভয়েস কলে ন্যূনতম ৪৫ পয়সা রেট ও সর্বোচ্চ দুই টাকা করা হয়েছে। এর আগে, একই অপারেটরে ফোন করলে সর্বনিম্ন কলরেট ছিল ২৫ পয়সা, আর এক অপারেটর থেকে অন্য যে কোনো অপারেটরে ফোন করলে কাটা হতো সর্বনিম্ন ৬৫ পয়সা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (বিটিআরসি) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১৪ আগস্ট থেকে ইউনিফর্ম কলরেট বাস্তবায়ন করছে মোবাইল অপারেটরগুলো। বিটিআরসি মনে করছে, মোবাইল ফোন বাজারের সিংহভাগ শেয়ার একটি মোবাইল কোম্পানির দখলে থাকায় ভিন্ন কলরেটের কারণে এতদিন সুবিধা পেয়ে আসছিল তারা। নতুন আইন অনুযায়ী, বাজারের শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠান কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেছিলেন, ‘যারা একটু দুর্বল অপারেটর তারা এবার একটু শক্তিশালী হতে পারবে।’
সর্বনিম্ন কলরেট বাড়ানো ও সব অপারেটরে সমান করার ক্ষেত্রে বিটিআরসির আরেকটি যুক্তি হলো, সরকারের এই নির্দেশনার ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। বিটিআরসির এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছিল কয়েকটি মোবাইল অপারেটর। তবে মাস না পেরুতেই ইউনিফর্ম কলরেট-র এই সিদ্ধান্তে গ্রাহকদের যেমন খরচ বেড়েছে ঠিক তেমনি অপারেটরগুলোর মুনাফাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে গ্রাহকেরা কথা বলার জন্য বিকল্প পথ ব্যবহার করছেন।
বেড়েছে খরচ, মোবাইলে কথা বলছে কম বিটিআরসির সিদ্ধান্তের আগে দেশের প্রায় সব অপারেটর একই অপারেটরের নাম্বারে কথা বলার জন্য নানা সাশ্রয়ী অফার দিত। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে বা গল্প করে বেশি। মোবাইল কোম্পানিগুলোও এ বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনা করে নানা অফার ঘোষণা করত। কিন্তু বিটিআরসির সিদ্ধান্তের পর গ্রাহকদের অভিযোগ মোবাইল ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে তাদের খরচ বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিটিআরসির সিদ্ধান্তে ৩০ শতাংশ খরচ বেড়েছে গ্রাহকদের।
চ্যানেল আইয়ের স্টাফ রিপোর্টার লুৎফর রহমান সোহাগ জানান, মোবাইলে কথা বলার ক্ষেত্রে তার খরচ বেড়েছে। আগে কলরেট বিড়ম্বনা স্ফীত বিকল্প মোবাইলে কথা বলার জন্য মাসে তার খরচ হতো ৬০০ টাকার মতো। এখন যেভাবে খরচ বাড়ছে তাতে ৮০০ টাকার বেশি খরচ হবে বলে মনে করছেন তিনি।
সোহাগ বলেন, ‘বাধ্য হয়েই এখন মোবাইল ফোনে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছি না। যোগাযোগের জন্য ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার করছি।’
ঢাকার শ্যাওড়াপাড়ার বাসিন্দা গৃহকর্মী মিলি আক্তার বলেন, ‘হিসাব করে দেখিনি। তবে মোবাইলের ব্যালেন্স খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলছি না।’
একটি বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সুজন ওয়াহিদ বলেন, ‘মোবাইলে খরচ বেড়েছে। আগে নির্দিষ্ট অফারে যে পরিমাণ কলটাইম পাওয়া যেত, এখন তার প্রায় ৪০ ভাগ কমেছে। ফলে আগের তুলনায় আগেভাগেই অফারের বান্ডেল শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
সর্বনিম্ন কল ৪৫ পয়সার চেয়ে কাটছে অনেক বেশি
বেসরকারি সংস্থা টিআইবির কর্মকর্তা প্রণব সাহার অভিযোগ, নতুন সিদ্ধান্তের পর সবগুলো অপারেটরে কলরেট অনেক বেড়েছে। বিটিআরসি ন্যূনতম খরচের জন্য যে ৪৫ পয়সা বেঁধে দিয়েছে সেটা থেকে অনেক বেশি কাটছে অপারেটরগুলো।
এ অভিযোগের সত্যতাও মেলে খোলা কাগজের অনুসন্ধানে। গ্রামীণফোন থেকে গ্রামীণফোনের নাম্বারে কল করে দেখা গেছে ৫৯ সেকেন্ডে কাটছে ১ টাকা ৩৩ পয়সা (ভ্যাটসহ)। বাংলালিংক থেকে রবি ৫৯ সেকেন্ডে ভ্যাটসহ কাটছে ৯১ পয়সা আর টেলিটক থেকে রবিতে ৫৯ সেকেন্ডে কাটছে ১ টাকা ৬ পয়সা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিটিআরসি অফলাইন-অনলাইন ভয়েস কলে ন্যূনতম কলরেট ৪৫ পয়সা করার পর বেশিরভাগ গ্রাহক মোবাইলে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে অপারেটরগুলো ন্যূনতম কলরেটের চেয়ে অনেক বেশি টাকা কাটছে প্রতিটি কলে। এর ফলে যে প্রান্তিক গ্রাহকদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বিটিআরসি নতুন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতি মিনিটে গ্রাহকদের কাছ থেকে ন্যূনতম কলরেটের চেয়ে অনেক বেশি টাকা কাটার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গ্রামীণফোনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসান তা অস্বীকার করে বলেন, ‘এমনটি হওয়ার কথা নয়। যে সব গ্রাহক বেশি টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ করছেন সেটা আদৌ সত্য নয়। সুনির্দিষ্ট কাস্টমার তথ্য দিলে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।’
বিটিআরসির নতুন সিদ্ধান্তে গ্রাহকরা যে ফোনে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন সেটার প্রমাণ মিলেছে প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ তালাত কামালের বক্তব্যে। তিনি বলেন, কলচার্জ সমন্বয়ের প্রভাব পরিমাপ করার সময় এখনো আসেনি, তবে আমরা গ্রাহকদের ফোন ব্যবহার কিছুটা হ্রাস পেতে দেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ইউনিফর্ম ট্যারিফ চালুর পক্ষে ছিলাম না, কারণ এর ফলে অন-নেট রেট বেড়েছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি যে রেগুলেটর বাজার কাঠামো পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা এখন গ্রাহকদের এই পরিবর্তনের সম্পূর্ণ সুবিধা দিতে বিভিন্ন প্যাকেজে আমাদের ট্যারিফগুলো পুনঃমূল্যায়ন করছি। আমাদের মিনিট প্যাকগুলো ব্যবহার করে গ্রাহকরা ৪৫ থেকে ৪৭ পয়সা ট্যারিফ উপভোগ করছেন।’
গ্রাহক ঝুঁকছে বিকল্পে
বিটিআরসির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৫ কোটির বেশি। এদের একটা বড় অংশই বর্তমানে স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। আর তাই দিন দিন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ফোনে কথা বলার খরচ বাড়ায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকছে অনেকে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যোগাযোগ ও কথা বলার জন্য ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, ইমো প্রভৃতি ইন্টারনেটভিত্তিক মাধ্যমে ঝুঁকছে।
লুৎফর রহমান সোহাগ বলেন, ‘গত কয়েক দিনে যোগাযোগের জন্য ফেসবুক মেসেঞ্জার বেশি ব্যবহার করছি। এতে অভ্যস্ত হয়েও পড়ছি।’
সুজন ওয়াহিদ অবশ্য বলেন, ‘মাস শেষে আমাদের মাপা মাইনে। তাই আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যয় করতে হয়। মোবাইল ফোনে কথা বলার জন্য আগে যে টাকা ব্যয় করতাম এখনো সেটাই করছি। শুধু কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি। যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক অ্যাপ বেশি ব্যবহার করছি।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন