কাল থেকে দ্বিতীয় দফা বাড়ছে গ্যাসের দাম
বৃহস্পতিবার থেকে দ্বিতীয় ধাপে বাড়তি গ্যাসের দাম কার্যকর হচ্ছে। গত ২৩ ফেব্রয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ভোক্তা পর্যায়ে দুই দফায় গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল।
দুই ধাপে তারা ৮ খাতে গড়ে ২২.০৭ শতাংশ দাম বাড়িয়েছিল। প্রথম দফার দাম কার্যকর হলেও আদালতের রায়ে আটকে যায় দ্বিতীয় দফার (১ জুন) দাম। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে আবার সে আদেশ স্থগিতও হয়ে যায়।
বিইআরসি বলছে, এই অবস্থায় দ্বিতীয় দফায় গ্যাসের দাম বাড়াতে আর কোনো বাধা নেই।
দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস অ্যান্ড ট্রান্সমিশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মশিউর রহমান জানান, ১ জুন থেকেই তারা দ্বিতীয় দফায় বাড়তি গ্যাসের দাম কার্যকর করবেন। বিইআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী তারা এই দাম কার্যকর করবেন বলেও জানান তিনি।
দ্বিতীয় দফায় দাম বৃদ্ধি কার্যকর হওয়ায় দুই চুলার গ্যাসের দাম পড়বে ৯৫০ টাকা আর এক চুলা ৯০০ টাকা। বাণিজ্যিকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম হবে ১৭.০৪ টাকা, সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটার হবে ৪০ টাকা।
ক্যাপটিভ পাওয়ার প্রতি ঘনমিটার ৯.৬২ টাকা, বিদ্যুৎ খাতের গ্যাসের দাম হবে ৩.১৬ টাকা, চা-বাগানে গ্যাসের দাম হবে ৭.৪২ টাক, সার কারখানায় ২.৭১ টাকা, শিল্পে ৭.৭৬ টাকা। এ ছাড়া গৃহস্থালি কাজে মিটার ব্যবহারকারীদের দাম হবে ১১.২০ টাকা।
জানা গেছে, দ্বিতীয় দফায় মূল্য বৃদ্ধির আদেশ কার্যকর হওয়ার ফলে বছরে সরকারের অতিরিক্ত আয় হবে ৪ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। এর ৮১ শতাংশ অর্থ যাবে সরকারি কোষাগারে। বাকি ১৯ শতাংশ অর্থ যাবে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্যাস কোম্পানির কোষাগারে। অন্যান্য কোম্পানির আয় দিয়ে সরকারের বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করার পরও সরকার তিন মাসের ব্যবধানে গ্যাসের দাম পরপর দুই দফায় বাড়ানোর অযৌক্তিক আদেশ চাপিয়ে দেয়ায় ভোক্তা পার্যায়ে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপরও। বেড়ে যাবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য।
শিল্পোদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গ্যাসভিত্তিক শিল্পে গ্যাসের দর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা থাকা উচিত। এটি নিশ্চিত করা গেলে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নেয়া সহজ হয়।
শিল্পে ব্যবহার করা গ্যাসের (ক্যাপটিভ) দাম ৮.৩৬ থেকে বেড়ে ৯.৬২ টাকা হওয়ায় অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখে পড়বে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে।
বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তাদের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ অর্থাৎ ক্যাপটিভ পাওয়ারের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকের জন্য সুতা কিংবা বস্ত্র উৎপাদন লাভজনক হবে না বরং লোকসান গুনতে হবে।
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটর দিয়ে স্পিনিং মিলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম পড়ে ৪ টাকা ২০ পয়সা। মূল্যবৃদ্ধির ফলে এখন দাম পড়বে সাড়ে ৯ টাকার বেশি। এতে প্রতি কেজি সুতার দাম ৪০ থেকে ৫০ সেন্ট (ডলার হিসেবে) বেড়ে যাবে।
জানা গেছে, মূল্যবৃদ্ধির ফলে গত ১ মার্চ থেকে আবাসিক খাতে দুই চুলার জন্য হয় ৮০০ এবং এক চুলার জন্য ৭৫০ টাকা দিতে হচ্ছে। কিন্তু তিন মাস যেতে না যেতে দ্বিতীয় ধাপে বৃহস্পতিবার থেকে দাম আরও বাড়বে। এসময় থেকে দুই চুলার জন্য ৯৫০ এবং এক চুলার জন্য ৯০০ টাকা দিতে হবে।
মার্চের আগে এক চুলার জন্য ৬০০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৬৫০ টাকা দিতে হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে এক লাফে দাম বেড়ে গেছে ৩০০ টাকা।
এছাড়া অন্যান্য খাতে যেমন বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সার, শিল্প, চা-বাগান, বাণিজ্যিক, সিএনজি ও গৃহস্থালিতে মিটার ব্যবহারকারীদের জন্যও একই হারে দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাণিজ্যিকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের জন্য ১১.৩৬ টাকা থেকে বেড়ে মার্চে হয়েছিল ১৪.২০ টাকা। এখন জুন থেকে হবে ১৭.০৪ টাকা। সিএনজির দাম ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে মার্চে হয়েছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩৮ টাকা। এখন জুনে আরও বেড়ে হচ্ছে ৪০ টাকা।
ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১ মার্চ থেকে প্রতি ঘনমিটারের দাম বেড়ে হয়েছিল ৮.৯৮। এখন ১ জুন থেকে হবে ৯.৬২ টাকা। বিদ্যুৎ খাতের গ্যাসের দাম মার্চ থেকে বেড়ে হয়েছিল ২.৯৯ টাকা আর জুন থেকে হচ্ছে ৩.১৬ টাকা।
চা-বাগানে গ্যাসের দাম মার্চ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৬.৯৩ টাকা আর ১ জুন থেকে হচ্ছে ৭.৪২ টাকা। সার কারখানায় মার্চে বেড়ে হয়েছিল ২.৬৪ টাকা এবং জুন থেকে হচ্ছে ২.৭১ টাকা। শিল্পে গ্যাসের দাম মার্চে বেড়ে হয়েছিল ৭.২৪ টাকা আর জুনে হচ্ছে ৭.৭৬ টাকা।
এছাড়া গৃহস্থালি কাজে মিটার ব্যবহারকারীদের দাম বেড়ে মার্চে হযেছিল ৯.১০ টাকা। এখন ১ জুন থেকে হচ্ছে ১১.২০ টাকা।
উল্লেখ্য ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বরও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন দুই চুলার বিল ৪৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা আর এক চুলার বিল ৪০০ টাকা থেকে বড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হয়েছিল।
বিইআরসির আইন অনুযায়ী কোনো সংস্থা এক বছরের মধ্যে মাত্র একবার দাম বাড়ানোর আবেদন করতে পারবে।
গ্যাসের দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, এভাবে দফায় দফায় গ্যাসের এই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বড় ধরনের অন্যায় ও অনিয়ম।
তিনি বলেন, গণশুনানিতে খোদ বিইআরসির টেকনিক্যাল কমিটি কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনাকে অযৌক্তিক বলে মত দিয়েছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
দ্বিতীয় দফায় দাম বাড়লে গণপরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাবে আবার। এখন রমজমান মাস। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে এই মাসেও একই হারে বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম। শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে।
গ্যাসের নতুন মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আদলতে একটি রিট করেন। পরে ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট ১ জুন থেকে দ্বিতীয় ধাপে কার্যকর হতে যাওয়া গ্যাসের নতুন মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ছয় মাসের জন্য স্থগিতের আদেশ দেন।
গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের এই আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দেন চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। আবেদনটি আগামী ৫ জুন আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
এর ফলে বিইআরসির সিদ্ধান্ত অনুসারে বৃহস্পতিবার থেকে দ্বিতীয় দফার বর্ধিত মূল্য কার্যকর হতে বাধা নেই বলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন