কিশোরগঞ্জে অটোরিকশা চালককে হত্যা, রায়ে ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে অটোরিকশাচালককে হত্যার দায়ে চারজনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। বুধবার বিকেলে কিশোরগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌস ইবনে হক এ রায় ঘোষণা করেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, ভৈরব উপজেলার ছনছড়া গ্রামের মৃত লতিফ মিয়ার ছেলে মো: লিটন মিয়া (২৫) একই গ্রামের আবু মিয়ার ছেলে মো: রব্বানী (২৫) ভাটি কৃষ্ণনগর গ্রামের খোকা মিয়ার ছেলে জুয়েল মিয়া (২৪) ও বাঁশগাড়ী গ্রামের মৃত আবু তাহেরের ছেলে মো: কাজল (৩৩)। অপরদিকে, নিহত রিকশাচালক সোহেল ওরফে বদন খন্দকার (৩৮) কুলিয়ারচর উপজেলার মাইজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম খন্দকারের ছেলে।

কিশোরগঞ্জ জেলা জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবু নাসের মো: ফারুক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আমরা আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণ যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি। আদালতের এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে বের হন অটোরিকশাচালক সোহেল ওরফে বদন খন্দকার। দুপুরে তার অটোরিকশাটি দাড়িয়াকান্দি বাসস্ট্যান্ডে রেখে বাড়িতে খেতে যান। দুপুর আড়াইটার দিকে আবার দাড়িয়াকান্দি থেকে চারজন যাত্রী নিয়ে ডোমরাকান্দা বাজারের উদ্দেশ্যে যান। পরে তিনি আর বাড়িতে ফিরে আসেননি। রাত ৯টার দিকে মোবাইলে কল দেন স্ত্রী সরুফা বেগম। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে রাতভর পরিবারের লোকজন বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান না পেয়ে পরদিন সকালে সাড়ে ৭টার দিকে সংবাদ পান ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ এলাকার ফারুক চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশে একটি মরদেহ পড়ে আছে। সেখানে গিয়ে বদন খন্দকারের মরদেহটি শনাক্ত করেন পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় ২৫ সেপ্টেম্বর নিহত মো. সোহেল ওরফে বদন খন্দকারের বাবা আবদুল হান্নান খন্দকার বাদী হয়ে ভৈরব থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।মামলা দায়েরের পর তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নিহতের ব্যবহৃত ফোনটি উদ্ধার করে পুলিশ। পরে সেই মোবাইল ফোনের সূত্র ধরেই অজ্ঞাত আসামিদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সন্দেহভাজন আসামি লিটন মিয়াকে ভৈরবের সম্ভুপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তার জবানবন্দির পরিপ্রেক্ষিতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত মো. রব্বানীকে ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ভৈরবের শিমুলকান্দি এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে দুইদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এরপর অপর দুই আসামি কাজল ও জুয়েল মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে অভিযুক্ত লিটন, কাজল এবং জুয়েলও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

জানা যায়, ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ভৈরবের শিবপুর বাজারে একটি পুরি-শিঙ্গাড়ার দোকানের সামনে বসে আসামি লিটন, মো. রব্বানী, জুয়েল ও কাজল অটোরিকশা ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। ওইদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আসামিরা ইজিবাজক ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ভৈরবের দূর্জয় মোড় বাসস্ট্যান্ড থেকে কালিকাপ্রাসাদ যাওয়ার কথা বলে সোহেল ওরফে বদন খন্দকারের অটোরিকশাটি ১০০ টাকায় ভাড়া নেন। ইজিবাইকটি কালিকাপ্রাসাদের একটি ফাঁকা জায়গায় পৌঁছামাত্র আসামি মো. রব্বানী প্রস্রাব করার কথা বলে ইজিবাইকটি রাস্তার পাশে থামায়। পরে চালক বদন খন্দকারকে ইজিবাইক থেকে নামিয়ে তার হাত বেঁধে ফেলেন এবং সঙ্গে থাকা লোহার রড দিয়ে ইজিবাইক চালকের নাক-মুখে এলোপাতাড়ি আঘাত করেন। পরে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে তার মোবাইল ও ইজিবাইকটি নিয়ে পালিয়ে যান। পরে ভৈরবের মুসলিম মোড় ব্রিজের কাছে অজ্ঞাত এক লোকের কাছে ৩০ হাজার টাকায় ইজিবাইকটি বিক্রি করে। এই ৩০ হাজার টাকার মধ্যে কাজল ৭ হাজার, মো. রব্বানী ৭ হাজার, জুয়েল ৩ হাজার ও বাকি টাকা নিয়ে যান লিটন।ঘটনার দুই-তিন মাস পর আসামি লিটন মিয়া, অপর আসামি মো. রব্বানীর শ্যালক জুয়েল মিয়ার মোবাইলের দোকানে মোবাইলটি চার হাজার টাকায় বিক্রি করেন। জুয়েল মিয়া মোবাইলের লক খুলে সেটি ভৈরবের শিমুলকান্দি ইউনিয়নের বাইশমা মধ্যপাড়া জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা জয়নাল আবেদীনের কাছে আট হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

এ ঘটনায় ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর নিহতের বাবা আব্দুল হান্নান খন্দকার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে ভৈরব থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. জামিল হোসেন জিয়া মামলাটি তদন্ত করে ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। দীর্ঘ সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত বুধবার এ রায় প্রদান করেন।