কিশোরগঞ্জে কোরবানির জন্য প্রস্তুত দুই লক্ষাধিক পশু

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সারা দেশের ন্যায় কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলার খামারের কর্মচারী-মালিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন শেষ মুহূর্তের পরিচর্যায়। দিন যত ঘনিয়ে আসছে ব্যস্ততাও বেড়েছে তাদের। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া। এসব খামারে ছোট-বড় সব আকারের পশু প্রস্তুত করা হয়েছে।

খামার গুলোতে দেশি জাতের গরু ছাড়াও রয়েছে ফ্রিজিয়ান, শাহী ওয়াল, ব্রাহামা, ইন্ডিয়ান বোল্ডারের মতো বড় জাতের গরু। এছাড়াও মহিষ, বলদ ও গয়াল। প্রাকৃতিকভাবে ঘাস, খড় কুটা, ভুসি খাইয়ে বড় করায় খামারে এসব গরুর চাহিদাও অনেক।

বাজারে দেশীয় গরুর ব্যাপক চাহিদা থাকায় ক্ষতিকর হরমোন কিংবা ইনজেকশনের ব্যবহার ছাড়াই দেশীয় পদ্ধতিতে গবাদিপশু পালন করা হয়েছে। ভারতীয় গরুর উপর নির্ভর না করে নিজেদের দেশীয় গরুতেই কোরবানির চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে মনে করছেন খামারিরা।

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৩টি উপজেলায় কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজারের মতো । এর মধ্যে চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৯১১টি, যা জেলার চাহিদা পূরণ করেও ৩০/৩৫ হাজার পশু দেশের চাহিদা পূরণ করবে। জেলায় ৭০ হাজার ষাঁড়, ৪ হাজার বলদ, সাড়ে ১৮ হাজার বকনা (গাভি), ১ হাজার ২৮৮টি মহিষ, ১ লাখ ১৩ হাজার ৮৯৬টি ছাগল, সাড়ে ৫ হাজার ভেড়া ও অন্যান্য কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার ১৩টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছোট বড় সব মিলিয়ে ১১৬টি গরুর খামার রয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ সদরে ১২টি, করিমগঞ্জ ১২টি, তাড়াইল ৭টি, হোসেনপুর ৭টি, পাকুন্দিয়া ১০টি, কটিয়াদী ১০টি, কুলিয়ারচর ৭টি, ভৈরব ৮টি, বাজিতপুর ১২টি, নিকলী ৭টি, ইটনা ৯টি, মিঠামইন ৭টি, ও অষ্টগ্রাম ৮টি। গ্রামে গঞ্জে এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে ২-৪টি গরু পালন হচ্ছে না।

প্রতি বছর গরু পালন করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে অনেকেই। শুধু কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে বিগত এক দশকে গরু লালন-পালন ও কেনা-বেচা করছেন হাজার হাজার মানুষ। সকল খামারগুলোতেই প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কোনো প্রকার ক্ষতিকারক ওষুধ ছাড়াই গরু মোটাতাজা করা হয়ে থাকে।

অল্প সময়ে গরু মোটাতাজা করতে যেন কোনো খামারি গরুকে বিভিন্ন প্রকার নিষিদ্ধ ওষুধ যেমন- হরমোন, ডেক্সামিথাজল, ডেকাসন, স্টোরেয়েড ইত্যাদি না খাওয়ায় তার জন্য জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তারা সর্বদাই সচেষ্ট রয়েছেন।

কোরবানীর ঈদের পশুর চাহিদা মিটিয়েও খামারীরা জেলার বাইরে বিক্রি করবে। এছাড়া জেলায় কোরবানীর পশু বিক্রির জন্য মোট ৬৩টি গরুর হাট রয়েছে। ৬৩টি হাটে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে ৪০টি ভেটেনারী মেডিকেল টিম কাজ করবে। কোন হাটে কোরবানীর পশু অসুস্থ্য বা স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রকার সেবা দেয়া হবে।

যদি কোন পশু ট্রাকে উঠা নামা করতে রাস্তায় অসুস্থ্য হয়ে পড়ে সেখানেও ভেটেনারী মেডিকেল টিম পৌছে যাবে। প্রতিটা হাটে জেলা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাতে করে পশুর মালিকরা পশু বিক্রি করে নিরাপদভাবে তাদের বিক্রিয়কৃত টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে।

একজন খামারি জানান , আমার খামারে কোরবানি উপযোগী ৬০টি গরু রয়েছে। সর্বনিম্ন ৮০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের গরু আছে। কোরবানি উপলক্ষে যে গরুগুলো লালনপালন করেছি সেগুলো ৮-৯ মাস ধরে লালনপালন করা। যেগুলো মাংস উৎপাদনের জন্য লালনপালন করা হয় সেগুলো ৩-৪ মাস। কোরবানির জন্য প্রস্তুতকৃত গরুপ্রতি প্রতিদিন আকার ভেদে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হয়।

প্রতিদিন দেশীয় জাতের এই গরু গুলোর খাবারের খাদ্য তালিকায় রয়েছে খৈল, ভুষি, খড়, সবুজ ঘাস, ভুট্টা গাছের সাইলেন্সার, ছোলা ও ঝাউয়ের মতো প্রাকৃতিক খাবার। প্রাকৃতিক উপায়ে সম্পূর্ণ ষ্টেরয়েড ও ইনজেকশনমুক্ত বিষুদ্ধ গো-খাদ্যের মাধ্যমে গরু বড় করে আমরা বিক্রি করে আসছি। আশা করছি বাহির থেকে কোনো গরু আনা হবে না। দেশীয় গরুর মাধ্যমে চাহিদা মেটানো সম্ভব। খামার থেকেই গরুগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপারি ও সাধারণ মানুষ ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় একটি এগ্রো ফার্মের মালিক জানান, আমরা কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করি না। সকাল-বিকাল নিয়ম করে খাবার দেই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি। গরু ভালোভাবে বেড়ে ওঠে। এখন ঈদের বাজারে তুলব, ভালো দাম পেলে পরের বছর আরেকটু বড় খামার করার চিন্তা করছি। তবে গোখাদ্যের দাম ও কাজের লোকের হাজিরা, সব মিলে একটি গরুর পেছনে যে ব্যয় হয় তা পুষিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হবে। আমার খামারে ১ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা মূল্যের গরু রয়েছে।

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুভাষ চন্দ্র পন্ডিত জানান, জেলায় মোট ৬৩টি গরুর হাট রয়েছে। এসব হাটে ক্রেতাদের নিরাপদ পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে ৪০টি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম কাজ করবে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ সদরে ৪টি, করিমগঞ্জ ৪টি, তাড়াইল ৩টি, হোসেনপুর ৩টি, পাকুন্দিয়া ২টি, কটিয়াদী ৬টি, কুলিয়ারচর ২টি, ভৈরব ৩টি, বাজিতপুর ৩টি, নিকলী ২টি, ইটনা ২টি, মিঠামইন ৪টি, অষ্টগ্রাম ২টি টিম কাজ করবে।

ডা. সুভাষ চন্দ্র পন্ডিত আরও জানান, প্রাকৃতিক উপায়ে খড়, ঘাস, খৈল, চালের কুড়া ও ভূষি খাইয়ে গরু মোটাতাজা করছেন খামারিরা। প্রস্তুত করা প্রাণী সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন, জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা। ওষুধের অপব্যবহার, রাসায়নিক খাবার বর্জনের ব্যাপারে খামারিদের নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে আসছেন তারা।

পাশাপাশি, রোগাক্রান্ত প্রাণী কিংবা কোরবানির অনুপযোগী প্রাণী কেনাবেচা না করার পরামর্শ দিচ্ছেন। এ বিষয়ে উপজেলা ভিত্তিক একটি করে ভেটেনারী মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রত্যেক উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।