কী ঘটতে যাচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদের রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ক বৈঠকে?
রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৃহস্পতিবারের আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং এর ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত একজন কূটনীতিক জানিয়েছেন, মঙ্গলবার নিজেদের মধ্যে আলোচনায় রাখাইনের সহিংসতা বন্ধ, রোহিঙ্গাদের মাঝে অবিলম্বে মানবিক সাহায্য কার্যক্রম শুরু ও কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের বাস্তবায়নে জোর দেওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ। সমন্বিত ও শক্তিশালী পদক্ষেপ চাইছে ফ্রান্স। আর মিয়ানমারকে স্পষ্ট বার্তা দিতে চাইছে ব্রিটেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো চায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। ভয়েস অব আমেরিকা বলছে, সেই নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব আসতে পারে পরিষদের বৈঠকে। তবে এতে ভেটো দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে রাশিয়া আর চীনের।
ক’দিন আগে বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রসহ সাত দেশ জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টনিও গুয়াতেরেজকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চলমান ‘জাতিগত নিধন’ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেন। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি সে সময় জানায়, আলোচনার দিনক্ষণ ঠিক করতে শলা-পরামর্শ চলছে। সেই শলা-পরামর্শ শেষে বৃহস্পতিবারকে আলোচনার দিন নির্ধারণ করা হয়।
নিউ ইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো তিনটি বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে: ১. মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ ২. রোহিঙ্গাদের মাঝে অবিলম্বে মানবিক সাহায্য কার্যক্রম শুরু এবং ৩. কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন। নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত ওই কূটনীতিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনার পর একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বৃহস্পতিবারের আলোচনায় ওই বিবৃতিতে দেওয়া বক্তব্য প্রাধান্য পেতে পারে।
এএফপির খবর অনুযায়ী, পরিষদের স্থায়ী-অস্থায়ী ৭ সদস্য ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাজাখস্তান, সেনেগাল এবং সুইডেন জাতিসংঘ মহাসচিবকে এই আলোচনার আহ্বান জানায়। আসছে বৈঠকে সভাপতিত্ব করবে ইথিওপিয়া। বুধবার মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ‘দ্রুত এবং কার্যকর’ পদক্ষেপ দাবি করেছেন। আগেও দুই দফা বৈঠক করেছে তারা। এদিকে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত জনাথন অ্যালেন জানিয়েছে, ‘মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে সহিংসতা বন্ধের স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে’। তিনি বলেন, মিয়ানমারে মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রহারা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী কিংবা নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতির প্রশ্নটি আলোচনা করা হবে।
জাতিসংঘের ফরাসি রাষ্ট্রদূত ফ্রান্সিস ডেলাট্রে জানিয়েছেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে ‘শক্তিশালী ও সমন্বিত জবাব’ দেওয়ার চেষ্টায় তৎপরতা চালাবে তার দেশ। ফ্রান্স অক্টোবরে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিত্বের দায়িত্ব নিয়েছে। আগামি সপ্তাহে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানকে তার রাখাইন প্রতিবেদন সম্পর্কে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। রাখাইন কমিশনের রিপোর্টে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের পক্ষে সুপারিশ হাজির করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চাইছে রোহিঙ্গা নিধনের অপরাধে নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব আনবে। জাতিসংঘ পরিচালক লউ চারবন্নিয়েউ বলেছেন, ‘বার্মিজ (মিয়ানমার) সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করা দরকার। অবরোধ আরোপ করা উচিত তাদের প্রতি যারা রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংস প্রচারণায় জড়িত’। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জাতিসংঘ মহাসচিব শিগগির এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।
কূটনৈতিক সূত্রকে উদ্ধৃত করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদে পরিস্থিতিরি উন্নতি না ঘটার সাপেক্ষে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হতে পারে। তবে রাশিয়া আর চীন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনও শক্ত পদক্ষেপের পক্ষে দাঁড়াবে না। প্রস্তাবটি তাই ভেটোর স্বীকার করে পারে। উল্লেখ্য নিরাপত্তা পরিষদে কোনও প্রস্তাব পাস হতে গেলে ১৫ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ৯টির ভোট পেতে হবে। পাশাপাশি স্থায়ী পাঁচ সদস্যের কেউ যেন ভেটো না দেয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে।
এর আগেও দুই দফায় রাখাইনের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে পরিষদে আলোচনা হয়েছে। সবশেষ আলোচনার পর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি বিবৃতিও দিয়েছে জাতিসংঘের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সেই প্রস্তাবে সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। সমালোচনা করা হয় অভিযানে বেসামরিকদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের। বৃহস্পতিবার একটি মুক্ত আলোচনা পর্বে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে আলোচনা হবে। এরপর জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা প্রশ্নে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করবেন।
রাখাইন পরস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় আগস্টের শেষ সপ্তাহে। সেখানকার ‘জাতিগত নিধন’ নিয়ে আলোচনার জন্য যুক্তরাজ্য ২৯ আগস্ট (মঙ্গলবার) আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ৩০ আগস্ট (বুধবার) আলোচনার দিন ধার্য হয়। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে রাখাইন ও রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পরিষদের সদস্যরা মিয়ানমারের এই দুইপক্ষের মধ্যে সহিংসতা বন্ধ, মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা ও রাখাইন পরামর্শক কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেন। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স সে সময় খবর দেয়, পরিস্থিতি খারাপ হলে ভবিষ্যতে আবার আলোচনা হতে পারে।
পরিষদের দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরে। ১৪ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক সময় বুধবার দুপুরে (বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত মধ্যরাত) ৯ বছর পর নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এক বিবৃতি দেওয়া হয়। বিবৃতিতে চলমান সহিংসতায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে সেখানকার সহিংসতা বন্ধেরও আহ্বান জানানো হয়।
২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর তথাকথিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।-বাংলা ট্রিবিউন
সূত্র: চ্যানেল নিউজ এশিয়া, রয়টার্স, বিবিসি, গার্ডিয়ান
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন