কুমিল্লার মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর ঐতিহ্যবাহী কোষা-নৌকার হাট
চলছে বর্ষা মৌসুম। ভারী বর্ষণ। নদ-নদীতে থই থই পানি। কুমিল্লার ঐতিহ্য রামচন্দ্রপুর বাজারে শত বছরের পুরানো নৌকার হাটে কোষা-নৌকা উৎসবের আমেজে ক্রেতা-বিক্রেতার ধুম পড়েছে। এদেশের জনপদে রাস্তা-ঘাট ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি হওয়ায় ডিঙি, ডোঙা, সাম্পান, বজরা, গয়না, বাইচের, বাতনাই, বাচারি, ময়ূরপঙ্খী, বালার, পানসী, পাতম, একমালাই, মলার, ইলশা ও সওদাগরী নৌকা বড় বড় পণ্যবাহী নৌকার বিলুপ্ত ঘটলেও শতবর্ষী রামচন্দ্রাপুর হাটে কোষা-নৌকার হাট এখনো টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
এই হাটে নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার, নরসংদীর মাধবদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর উপজেলা। কুমিল্লার হোমনা, তিতাস ও মুরাদনগর উপজেলার শত শত মানুষ নৌকা কিনতে ও বিক্রি করতে আসছেন। মুরাদনগর উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের ৩০৮টি গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদী, গোমতী নদী, আরচি নদী, বুড়ি নদী, অদের খাল, নিমাইজুড়ি খাল, বিল, হাওর বাঁওড়ে প্রতিটি জনপদে বাড়ছে পানি।
আর কদর বেড়েছে ছোট ছোট নৌকার। সরজমিন রামচন্দ্রপুর নৌকার হাটে গিয়ে দেখা গেছে, মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাটে রামচন্দ্রপুর বাজার বাস টার্মিনাল ও কাচারি বাজারে এলাকা জুড়ে নানা ঢংয়ের ছোট ছোট নৌকা।
পুরো এলাকা দৃষ্টিনন্দন করেছে সারিবদ্ধভাবে রাখা শত শত কোষা-নৌকা। ক্রেতাদের ভিড়ে জমে উঠেছে হাট। এখানে সাধ্যের মধ্যে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য পাওয়া যাচ্ছে নানা মাপের নৌকা। কাঠ মিস্ত্রিরা এমনিতে নৌকা প্রস্তুত করে রাখেন। ভাটি অঞ্চলের মানুষ রামচন্দ্রপুর বাজার ও ডুমুরিয়া বাজার হাট থেকে নৌকা কিনেন।
কৈজুরি গ্রামের নৌকার কারিগর রামপ্রসাদ সরকার ও বিক্রেতা বিমল সরকার বলেন, সপ্তাহে প্রতি জন কারিগর ১০ থেকে ১২টি নৌকা তৈরি করে হাটে নিয়ে আসি। বর্তমানে কাঠ ও লোহাসহ অন্যান্য সাঞ্জামাদির দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরিতে খরচ বেড়েছে। আমরা জামরুল, রেইনট্রি, আম, কদম ও শিমুল কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করি। নৌকা কিনতে আসা নবীনগর উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের বাজে বিশাড়া গ্রামের মাহমুদুর রহমান সুমন বলেন, আমার মাছের প্রজেক্ট আছে। আমাদের গ্রামটি ছোট ও খুবই নিচু এলাকা। সামান্য বর্ষাতে রাস্তা-ঘাট ও ব্রিজ তলিয়ে যায়। বর্ষার সময় একমাত্র বাহন হচ্ছে নৌকা।
নৌকা ঘাটের ইজারাদার মুশিদ মিয়া বলেন, এখানে নামে মাত্র ট্যাক্স দিয়ে নৌকা নেয়া হয়। এসবের মধ্যে হাতে বাওয়া নৌকা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। ছোট নৌকা ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা, মাঝারি নৌকা ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং বড় নৌকা ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
আমিননগর গ্রামের ইউপি’র সদস্য মো. আলমগীর হোসেন ও স্থায়ী বাসিন্দা মো. ইব্রাহীম খলিল বলেন, বছরে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত এই অঞ্চলের কোষা-নৌকার সবচেয়ে বড় হাট বসে। এসময়ে সচরাচর বর্ষা দেখা দেয়। রামচন্দ্রপুর নৌকার হাটে এসময় ভিড় লেগেই থাকে। নৌকা তৈরির কারিগররা দিন-রাত কাজ করছেন। এখন তাদের ব্যস্ত সময়। আয়ের সময়।
রামচন্দ্রপুর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মোহা. জীবন মিয়া মেম্বার বলেন, রামচন্দ্রপুর বাজারের নৌকা বিক্রির প্রচলন শত বছরের অধিককাল আগে থেকেই প্রতি মঙ্গলবার হাট বসে। বিভিন্ন জেলা থেকে নৌকার ক্রেতা-বিক্রেতারা তাদের সাধ্যের মধ্যে নৌকা ক্রয়-বিক্রয় করে থাকেন।
রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইকবাল হোসেন সরকার বলেন, রামচন্দ্রপুর বাজারের আশপাশের উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে বর্ষা আসলেই লোকজন নৌকার কিনতে আসেন। প্রতি মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০০ থেকে ৩০০ নৌকা বেচাকেনা হয়। এঞ্চলের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের নৌকা পাওয়া যায়।
মুরাদনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ড. আহসানুল আলম সরকার কিশোর বলেন, তিতাস নদীর পাড়ে রামচন্দ্রপুর বাজারটি আমার ইউনিয়নে পড়েছে। রামচন্দ্রপুর বাজার নৌকা হাটটি কুমিল্লা জেলা ঐতিহ্যর সঙ্গে মিশে আছে। মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা জল ও স্থল পথে রয়েছে।
ঐতিহাসিক রামচন্দ্রপুর বাজার সাপ্তাহিক হাটের সুনাম রয়েছে নারায়ণগঞ্জ, নরসংদী, বাবুর হাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জুড়ে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই হাটে নৌকা কিনতে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। রামচন্দ্রপুর বাজার নৌকার ঘাটে এখন ক্রেতার-বিক্রেতার ভিড় থাকে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন