কুমিল্লায় অযত্ন-অবহেলায় বিলুপ্তির পথে জাতীয় কবির স্মৃতিচিহ্ন
দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য কর্মের বিরাট একটি অধ্যায়জুড়ে রয়েছে কুমিল্লার নাম। ২৫ মে ছিলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মবার্ষিকী। এছাড়া চলতি বছরের ৫ এপ্রিল জাতীয় কবির কুমিল্লায় আগমনের শতবর্ষ পূর্ণ হয়। সে সময় জাতীয় কবির কুমিল্লায় আগমনের শতবর্ষ বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালন করার পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কারণে সকল অনুষ্ঠান স্থগিত করে জেলা প্রশাসন। জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কুমিল্লার নজরুলপ্রেমীরা বলছেন, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় কুমিল্লায় নজরুল থাকবেন চির অম্লান হয়ে। কবিপ্রেমীদের ভাষ্য, কুমিল্লায় বিচরণের মধ্য দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হয়ে উঠেছিলেন। কুমিল্লায় নজরুল আর নজরুলের কুমিল্লা বিষয়টি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। জাতীয় কবির প্রেম, বিয়ে, প্রকাশ্যে সুরকার-গায়ক ও অভিনয় শিল্পী হয়ে ওঠাসহ অনেক কিছুরই প্রথম শুরু কুমিল্লা থেকে। জাতীয় কবি ১৯২১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ দফায় ১১ মাস কুমিল্লায় ছিলেন। এই সময়ে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেপ্তারও হন। কবি কুমিল্লার বিভিন্ন বাড়িতে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে আড্ডা দিতেন, সংগীতচর্চা ও কবিতা আবৃত্তি করতেন। লিখতেন গান ও কবিতা। কুমিল্লায় কাটানো সময়গুলো ছিল কবির জীবনের স্বর্ণালি সময়। তাঁর জীবনে যে দু’জন নারী এসেছিলেন, সে দুজনও কুমিল্লার। এদিকে জাতীয় কবির কুমিল্লা স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লায় অনেক নিদর্শন এখনো রয়েছে অবহেলায়। সংরক্ষণ এবং উদ্যোগের অভাবে সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লা নগরীতে স্থাপিত ১২টি স্মৃতিফলকের মধ্যে অধিকাংশরই এখন করুণ অবস্থা। নজরুলের প্রেম, বিয়ে-বিচ্ছেদ, গ্রেপ্তার ও কাব্যচর্চাসহ বহু ঘটনার সাক্ষী হিসেবে ১৯৮৩ সালে স্থাপন করা হয়েছিলো স্মৃতিফলকগুলো। নজরুলকে নিয়ে চর্চা ও গবেষণা জন্য ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল উদ্বোধন হয় নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র।
জাতীয় কবিকে নিয়ে গবেষণা করা কুমিল্লায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আলী হোসেন চৌধুরী এখন পর্যন্ত নজরুলকে নিয়ে সাতটি বই লিখেছেন। নজরুল গবেষক আলী হোসেন চৌধুরী বলেন, কুমিল্লা নজরুলের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কুমিল্লাকে বাদ দিয়ে কবির জীবনী রচনা করা যাবে না। অনেকে বলছেন পাঁচ দফায় কবি ১১ মাস কুমিল্লায় ছিলেন, কিন্তু আমার গবেষণায় দেখেছি কবি এক বছরের বেশি সময় কুমিল্লায় অবস্থান করেছেন। কুমিল্লাতে তিনি ৫৩টি রচনা, কবিতা, গান লিখেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে যা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। কবির জীবনের প্রথম অনেক কিছুই ঘটেছে কুমিল্লায়। কবি প্রথম প্রেম ও বিয়ে করেছেন কুমিল্লায়, দ্বিতীয় বিয়েও কুমিল্লায়। তিনি কুমিল্লায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মিছিলে গান লিখে এবং সুর করে প্রথম প্রকাশ্যে গায়ক ও সুরকার হিসেবে আবির্ভূত হন। কবির প্রথম প্রকাশ্য মঞ্চ নাটক কুমিল্লা টাউন হলে। তিনি গানের প্রথম প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কুমিল্লাতে। এমন অনেক কিছুই আছে কবির জীবনে যার প্রথম কুমিল্লা জেলায়। কুমিল্লায় বিচরণের পর কলকাতায় গিয়ে নজরুল হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহী কবি।
তিনি আরও বলেন, তবে কুমিল্লায় নজরুলের অনেক স্মৃতিচিহ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। স্মৃতিফলকগুলোও এখন নাজুক অবস্থায় রয়েছে, অনেকগুলো এখন আর নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে উদ্দেশ্য নিয়ে নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিলো তার মোটেও প্রতিফলন নেই। এখানে নজরুলকে নিয়ে চর্চা ও গবেষণা হচ্ছে না। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে এখন পর্যন্ত কবির নামে কুমিল্লায় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়নি।
কুমিল্লার আরেক শিক্ষাবিদ ও নজরুল গবেষক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক নজরুলকে নিয়ে ১২টি বই লিখেছেন। শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বলেন, নজরুলের স্মৃতিচিহ্নগুলো দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেই। আমি সব সময় দেখছি কুমিল্লায় নজরুলকে নিয়ে একটা ‘লুকোচুরি’ খেলা চলে। এমন অনেকেই নজরুল পরিষদের দায়িত্ব পালন করেছেন বা করছেন, যারা আসলে নজরুল সম্পর্কে কিছুই জানে না এবং বোঝেন না। কুমিল্লায় নজরুলকে নিয়ে এখন পর্যন্ত যেটুকু হয়েছে, তার প্রায় সবটুকুই হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। নজরুল ইনষ্টিটিউটে শুধুমাত্র সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা হয়, কিন্তু নজরুলকে নিয়ে কোন গবেষণা হয় না। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। শুধুমাত্র কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়, ক’দিন পরেই সবাই ভুলে যাই। এরপরও আমি বলবো কুমিল্লায় নজরুল থাকবে চির অম্লান হয়ে। তবে সম্প্রতি এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা নজরুল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অশোক বড়ুয়া বলেন, আমরা জাতীয় কবিকে নিয়ে সারা বছরই বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি। কবির স্মৃতিচিহ্নগুলো রক্ষায় আমরা বিভিন্ন কাজ করছি।
উল্লেখ্য, কুমিল্লার গোমতী নদীর এপারে প্রমীলা আর ওপারে নার্গিস ছিলেন কবির হৃদয়ের সারথী। এই দু’জনকে ঘিরেই কবি নজরুলের প্রেম আর বিরহের অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত কেটেছে কুমিল্লা নগরী ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে। কবির দুই জীবন সঙ্গীর প্রথমজন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের খাঁ বাড়ির আলী আকবর খানের ভাগনি নার্গিস আসার খানম আর অপরজন কুমিল্লা নগরীর বসন্ত কুমার সেনগুপ্তের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা দুলী। তবে কবি তাঁর নাম দিয়েছিলেন প্রমীলা। ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর রাজগঞ্জ বাজারে কবি ব্রিটিশবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর শহরের ঝাউতলা সড়কের শেষ প্রান্তে রাস্তার দক্ষিণ পাশ থেকে ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতার জন্য কবি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ সংলগ্ন রানীর দীঘির পাড়ের পশ্চিম-দক্ষিণ কর্নারে বসে কবি গান ও কবিতা চর্চা করতেন। এছাড়া জাতীয় কবির অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে কুমিল্লার নগরী ও মুরাদনগরের দৌলতপুরের মাটির সঙ্গে। যা সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক স্থানে নেই কোনো স্মৃতিফলকও।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন