বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া উদ্বোধনের কতদূর?
এইচ.এম নুর আলম : বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেরিয়ে গেছে আটটি বছর। তিন উপাচার্যের আমলের সাক্ষী উত্তরবঙ্গের ‘অক্সফোর্ড’খ্যাত রংপুরের এই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)। এর মধ্যে শেষের দিকে নানা আন্দোলন আর টানাপোড়েনে কেটেছে সাবেক উপাচার্য ড. আব্দুল জলিল মিয়া ও ড. একে এম নূর-উন-নবী’র আমল। কিছু কাজ চললেও অবহেলায় রয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, সাইবার সেন্টার, ফটক নির্মাণসহ সহ নানা কাজ। এখনও নির্মাণ হয়নি একটি তোরণও। অলস পড়ে আছে শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের প্রহর কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া।
নির্মান কাজ সম্পন্নের চার বছর হতে চললেও উদ্বোধনের স্থবিরতা কাটছেনা ক্যাফেটেরিয়ার। ২ কোটি ৯ লাখ টাকা বাজেটের ৪ তলাবিশিষ্ট ভিত্তির ১ম পর্যায়ে ২য় তলা স্থাপনের দীর্ঘদিন পেড়িয়ে গেলেও নানা অজুহাতে উদ্বোধন হচ্ছেনা ক্যাফেটেরিয়া।১০২১ স্কয়ার মিটার বিশিষ্ট ক্যাফেটেরিয়া যে উদ্দেশ্যে নির্মানের কথা রয়েছে তার একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি এখনও। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী,কর্মকর্তা-কর্মচারিরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নাই নাই’ হাহাকারের মধ্যে প্রহর গোণার সাক্ষী ক্যাম্পাসের ঘাসবন-কাশবন আর বৃক্ষ-তরুলতা। তৃতীয় উপাচার্য হিসেবে মেয়াদ শেষে (৫ মে) ড. এ কে এম নূর-উন-নবী যাওয়ার পর এই নানা সমস্যা আর জটিলতার মাঝেই গত ১৪ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, বিটিএফও।
শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারি বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি ক্যাফেটেরিয়া উদ্বোধন করা। কিন্তু এটি উদ্বোধনে কতদূর এগিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? কবে খুলে দেবে এই অপেক্ষার প্রহর গোণা ক্যাফেটেরিয়া। আদৌ কি এখানে বসে শিক্ষার্থীরা খাবার খেতে পারবে? আদৌ কি গর্বে করে বুক উঁচিয়ে বলতে পারবে-এই হলো আমাদের ক্যাফেটেরিয়া? এই সব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মনে।
উপাচার্যের কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে এসব বিষয়ে কাজ চলছে বলে জানালেও কবে নাগাদ এটি উম্মোচন করা হবে তা ভবিষ্যতই জানে। তবে একটি অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপাচার্যের তৃতীয় পরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন বৃদ্ধি করে কিছু স্ট্রাকচারে পরিবর্তন আনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণ, ক্যাফেটেরিয়া ভবন সংস্কার ও উদ্বোধনের কথা জানা গেছে। তবে উপাচার্য উন্নতমানের ক্যাফেটেরিয়া সংস্কারের আভাস দিয়েছেন। তিনি তিন ধাপের পরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন বৃদ্ধি করে এসব বিষয়ে হাত দিবেন বলে জানান। এই দীর্ঘমেয়াদী কাজগুলো সম্পœœ করতে ছয়মাসের বেশি সময় নেবেন না বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানা যায়, ১ম পর্যায়ের (২০০৯-১২) ১৬ টি প্রকল্পের একটি হলো দুই তলাবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া নির্মান। এর নির্মাণ কাজ সম্পন্নের কথা ছিলো ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। কিন্তু সেটি বাড়িয়ে ২০১৩ সালের জুনের মধ্যে সম্পন্নের কথা থাকলেও বিভিন্ন অজুহাতে তা হয়নি। ২০১৩ সালে ক্যাফেটেরিয়ার নির্মান কাজ সম্পন্ন হলেও এখনও উদ্বোধন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ক্যাফেটেরিয়া নির্মানের উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, একটি ব্যাংক, মেডিকেল সেন্টার, সেলুন (হেয়ার কার্টিংস), বিভাগীয় স্টোর (যেখানে শিক্ষার্থীদের খাতা, কলম, বই পাওয়া যাবে), ক্যান্টিন থাকবে। কিন্তু তার একটিও আজ পর্যন্ত চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে অবহেলায় পড়ে থেকে ময়লা জমে গেছে ক্যাফেটেরিয়ার দেয়ালে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্থায়ী ব্যাংক না থাকায় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারিদের টাকা তুলতে হয় রংপুরের লালবাগ শাখায় জনতা ব্যাংকে গিয়ে দিনের পর দিন। প্রতিদিন ব্যাংকের লোককে এখানে আসতে একাডেমিক কাজে। মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদেরও লালবাগ শাখায় গিয়ে বিভিন্ন একাডেমিক কাজের টাকার লেনদেন করতে হচ্ছে। ফলে হয়রানির শিকার হচ্ছে অনেকেই। ক্যাফেটেরিয়ার ২য় তলায় ব্যাংকের জন্য বরাদ্দ থাকলেও তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ মিলছেনা প্রশাসনের। অর্থব কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া কমিটি। এর মাঝেই পদত্যাগ করেছেন ২য় দফায় গঠিত কমিটির আহ্বায়ক ড. সাইদুর রহমান (শিমুল মাহমুদ)।
নির্মানের প্রায় ২ বছর পর ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল ক্যাফেটেরিয়া চালুর উদ্দেশ্যে তৎকালীন বিজনেজ অনুষদের ডিন ড. মতিউর রহমানকে সভাপতি ও নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে সেক্রেটারি করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।
পরে কমিটির সেক্রেটারির কার্যকর অংশগ্রহনের অভাবে কমিটির কোনো সভা আহ্বান না করা এবং ক্যাফেটেরিয়া চালুর বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহন না করা এবং মৌখিকভাবে কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানোর পরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ তুলে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন ড. মতিউর রহমান।
এর ৬ মাস পর কলা অনুষদের ডিন সাইদুর রহমান ও অ্যাকাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক শাহীনুর রহমানকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। নতুন উপাচার্য আসলে আহ্বায়ক সাইদুর রহমানও কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন ক্যাফেটেরিয়া চালু না করতে পারার ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ।
ক্যাফেটেরিয়া নিয়ে সাবেক উপাচার্যের সময়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২০১৪ সালে ক্যাফেটেরিয়ার কাজ শেষ হয় এবং ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝিয়ে নেওয়া হয় ২০১৫ সালের জুন মাসে। তিনি বলেন, আপাতত ক্যাফেটেরিয়ার প্রথম তলায় শিক্ষার্থীদের ক্যান্টিন ও দ্বিতীয় তলায় শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ক্যান্টিন চালু করা হবে। ২য় তলায় ব্যাংক স্থাপনের উদ্দেশ্য থাকলেও তিনি বলেন এর পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে। আর মেডিকেল সেন্টারের কথা বললে তিনি বলেন, এটার জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ করা হবে।
বর্তমানে মাঝে মাঝে ক্যাফেটেরিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সামাজিক ও সাংগঠনিক সংগঠনগুলো তাদের সভা, সেমিনারের জন্য ব্যবহার করছে। শিক্ষার্থীরা ক্যাফেটেরিয়ার সামনের মাঠে বসে বিকালে আড্ডা জমায়। ক্যাফেটেরিয়ার সঠিক ব্যবহার, পরিচ্ছন্নতার অভাবে ময়লা জমে যাচ্ছে এবং নির্মাণ কৌশলের কারণে দেয়াল ধ্বসে যাওয়ারও সম্ভানা রয়েছে।
গেল বছর এবং চলতি বছরেও ক্যাফেটেরিয়া উদ্বোধন নিয়ে রংপুরের স্থানীয় দৈনিক মায়াবাজারসহ বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইনে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ক্যাফেটেরিয়া উদ্বোধন না হওয়ায় বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের কষ্ট এবং ক্ষোভ প্রকাশিত হলেও তাতে কান দেয়নি নানা অনিয়মের দায়ে প্রমাণিত প্রফেসর নূর-নবী প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ক্যাফেটেরিয়া উদ্বোধন নিয়ে ‘প্রসেসিং চলছে’ বলেই কাটিয়ে দিয়েছেন তাঁর সময়ের চারটি বছর। কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং ক্যাফেটেরিয়াসহ নানা বিষয় নিয়ে গত দুই উপাচার্যের সময়ে হওয়া উপাচার্যবিরোধী তীব্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক সংগঠনগুলোর মানববন্ধন-সমাবেশ হয়েছিলো। গত বছরের ১৩ মে মসজিদটি কোনোমতে উদ্বোধন হলেও অজ্ঞাতকারণে আটকে আছে ক্যাফেটেরিয়া উদ্বোধনের কাজ। এটি উদ্বোধনে দুটি টেন্ডারের কথা জানা গেলেও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে সেটি। তবে ক্যাফেটেরিয়া উদ্বোধনের কাজটি পর পর দুটি কমিটির হাতে দিলেও স্থানীয় প্রভাবশালিদের দৌরাত্ম এবং রাজনৈতিক কারণে হয়নি বলে বলে গিয়েছেন সাবেক উপাচার্য।
সেই সময় স্থানীয় পত্রিকা ও অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ এবং বর্তমান শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী, ক্যাফেটেরিয়া উদ্বোধন না হওয়ায় একটি কলম বা খাতা কেনার জন্য হাফ কিলোমিটার হেটে যেতে হয় সকল স্তরের লোকদের। হলে খাবার না চললে হাফ কিমি দূরে হেটে গিয়ে খাবার খেতে হয় দোকানগুলোতে। এতে ক্লাসের বিরতির ফাঁকে খাবার ইচ্ছা করলে হাফ কিমি হাটতে হয় সকলকে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী ক্যান্টিন চালু থাকলেও গত বছরে দলীয় কোন্দলে বন্ধ হয়ে যায় সেটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ক্যান্টিন, খাবার দোকান বা ফুডসপ না থাকায় পাশের বাজার পার্ক মোড়ে শিক্ষার্থীদের খেতে গিয়ে কয়েকবার স্থানীয়দের মারধরের শিকার হতে হয়েছে । চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে এ ধরণের কয়েকটি ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে আছে শিক্ষার্থীরা। পরে স্থানীয়দের সাথে মীমাংসা করতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের বাইরে মেসগুলোতে থাকার বিষয়টি বিবেচনা করে।
শিক্ষক সংশ্লিষ্ট বেতন- বোনাস আদায় হলেও আন্দোলন পরবর্তী শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মাঠে নামতে দেখা যায়নি ঐ সময়ের আন্দোলনে নের্তৃত্বদানকারিদের। ফলে ক্যাফেটেরিয়াসহ অন্যান্য স্বার্থ ব্যহত হয়েছে শিক্ষার্থীদের। তবে সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রত্যাশা নতুন উপাচার্য নিশ্চয়ই কাজটি অতিদ্রুত সময়ে সম্পন্ন করবেন।
সুতরাং বর্তমান উপাচার্যের নিকট প্রত্যাশা, তিনি যেনো সকলের প্রত্যাশার প্রহর এই ক্যাফেটেরিয়া দ্রুত উদ্বোধনের উদ্যোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে অগ্রগামী হন।
এইচ. এম নুর আলম
শিক্ষার্থী,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন