কোরবানিতে দেশি পশুতেই চাহিদা ‘মিটবে’

বর্তমানে দেশে যে সংখ্যক জবাই উপযোগী গরু, মহিষ ও ছাগল আছে, তা দিয়েই কোরবানির চাহিদা পূরণ সম্ভব বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। অধিদফতরের হিসাবে, গত বছর কোরবানি উপলক্ষে সারা দেশে এক কোটি পাঁচ লাখ গবাদিপশু বিক্রি হয়, সেখানে এবার দেশে কোরবানিযোগ্য পশু আছে এক কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার।

কোরবানির জন্য ‘প্রয়োজনের চেয়ে বেশি’ গরু থাকায় এবার ভারত থেকে গরু আনা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন খামারিরা।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আইনুল হক বলেন, ‘গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বনির্ভর। এসব প্রাণির উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এখন যে পরিমাণ গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া আছে তা-ই সাফিসিয়েন্ট।’ অধিদফতরের হিসাবে, দেশজুড়ে সারা বছরে প্রায় দুই কোটি ৩১ লাখ ১৩ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া জবাই হয়। এর প্রায় ৫০ ভাগ জবাই হয় কোরবানির ঈদের সময়।

সে হিসাবে এক কোটি ১৫ লাখের মতো গবাদিপশু দরকার হবে কোরবানির সময়, যা এখন দেশের খামারি ও গৃহস্থদের ঘরে রয়েছে। আইনুল হক জানান, বর্তমানে দেশে কোরবানি উপযোগী গবাদি পশুর মধ্যে ৪৪ লাখ ৫৭ হাজার গরু ও মহিষ রয়েছে এবং ছাগল-ভেড়া আছে ৭১ লাখ। সারা দেশের পাঁচ লাখ ২২ হাজার ২৮৯ জন খামারি এবং উপজেলা পর্যায়ে কৃষকের কাছে থাকা গবাদিপশুর তথ্য নিয়ে এই হিসাব করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

আইনুল হক বলেন, ‘আমরা খামারি লেভেল থেকে হিসাব নিয়েছি। এছাড়া আমাদের প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী আছে, তারাও আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। এভাবেই এই সংখ্যা বের করা হয়েছে।’ কয়েক বছর ধরে ভারত থেকে গরু আসা কমে যাওয়ায় দেশে গবাদিপশু পালন আগের চেয়ে বেড়েছে বলে খামারি ও কৃষকরা জানিয়েছেন।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার মাজহাড গ্রামের খামারি মো. হাজ্জাজ আলী বলেন, ‘গত দুই বছর ভারত থেকে গরু কম আসায় কৃষকরা কিছুটা লাভবান হওয়ায় সবাই আরও উৎসাহী হয়েছে। গরু প্রচুর বেড়েছে। শুধু আমাদের এলাকায় কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ জন নতুন খামারি এবার গরু পেলেছে।’

ভারতীয় গরু ঢুকলে লোকসানে পড়বেন শঙ্কা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুনেছি পুটখালী সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন গরু ঢুকছে। গরু ঢোকা বন্ধ না করলে আমরা মার খাব।’ কুষ্টিয়া জেলায়ও কোরবানি উপলক্ষে গতবারের চেয়ে এবার বেশি গরু পালন করা হয়েছে বলে জানান সদর উপজেলার বাঘডাঙা গ্রামের কৃষক শেখ সিরাজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় বড় খামারি নাই। কিন্তু কৃষকরা একটা দুইটা করে গরু পালে। প্রায় সবার ঘরেই একাধিক গরু আছে। এবার আগের চেয়ে বেড়েছে।’

গত বছর সারা দেশে ৪০ লাখ গরু কোরবানি হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, ‘এবার চাহিদার চেয়ে বেশি গবাদিপশু দেশেই রয়েছে, তাই ভারতীয় গরু আমদানির প্রয়োজন নেই। বর্তমান অবস্থায় ভারত থেকে যারা গরু আনবে তারাও লাভবান হবে না। কারণ চাহিদার চেয়ে গরু অনেক বেশি হয়ে গেলে দাম পড়ে যাবে। খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

দেশের মাংসের চাহিদা পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য ভারত থেকে গরু আনা বন্ধ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন খামারিদের সংগঠনের এই নেতা। তিনি বলেন, ‘এখন আমরা একটা পরিবর্তনের মধ্যে আছি। ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ হলে কৃষকের পাশাপাশি বড় বড় বিনিয়োগকারীরা এ খাতে বিনিয়োগ করবে। বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক উৎপাদন শুরু হলে সরবরাহ বেড়ে মাংসের দামও কমে যাবে।’

ইমরান জানান, গত বছর নিজের খামারে সাড়ে তিনশ গরু মোটাতাজা করেছেন। এ বছর আছে সাড়ে পাঁচশ গরু।

ভারতের গরু এলে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক আইনুল হকও। তিনি বলেন, ‘এটা হলে আমাদের খামারিরা একেবারে পথে বসবে। খামারিদের প্রায় ৯০ শতাংশই ঋণ করে গরু মোটাতাজা করছে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। এ খাত দাঁড়াতে পারবে না।’ ভারতীয় গরু আনা ঠেকাতে পদক্ষেপ চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

ভারতীয় গরু আনা বন্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণচন্দ্র চন্দ বলেন, ‘তারপরও নানা ফাঁকফোকর দিয়ে কিছু গরু চলে আসে। এদের ঠেকানো কঠিন। তবে তা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। আমরা চাই না, বাইরে থেকে গরু আসুক, আমাদের খামারিরা মার খাক।’

তিনি বলেন, ‘ভারতের গরু আসার প্রয়োজন নেই। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবের চেয়ে বাস্তবে দেশে জবাই উপযোগী গবাদিপশুর সংখ্যা বেশি। আমরা যে সংখ্যাটি বলছি তা আমাদের হিসাবের ভেতর যা আছে সেটা। এর বাইরেও অনেক আছে। সব হিসাবের ভেতর আনা যায় না। বাস্তবে গবাদিপশুর সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। ফলে সারা বছরের মাংসের চাহিদাও আমাদের গরু দিয়েই মেটানো সম্ভব, ঘাটতি হওয়ার কথা না। ঘাটতি হলে তখন আমরা দেখব কী করা যায়।’

প্রতিমন্ত্রী ও খামারিরা একথা বললেও ঢাকা গবাদিপশু ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আমজাদ হোসেন মণ্ডল বলছেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতীয় গরু ছাড়া সারা বছরের মাংসের চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। মাংস ব্যবসায়ীদের ইন্ডিয়ান গরু দরকার। না হলে তারা টিকে থাকতে পারবে না। আগামী ২-৪ বছর ইন্ডিয়ান গরু ছাড়া আমাদের চলবে না। তবে আমরা যদি আস্তে আস্তে স্বনির্ভর হতে পারি তাহলে হয়ত আগামী ৮-১০ বছর পর ভারত থেকে আর গরু আনতে হবে না।’