কোরবানীর শিক্ষা: প্রকৃত সুখ ও আনন্দ ভোগে নয়, ত্যাগে
কোরবানীর শিক্ষা: প্রকৃত সুখ ও আনন্দ ভোগে নয়, ত্যাগে
আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবু নসর
মহান স্রষ্টার প্রতি সঠিক আনুগত্য, তার সন্তুষ্টি ও মানব কল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করাই মূলত: ঈদুল আযহা বা কোরবানি ঈদ। এ ঈদের আনন্দ হলো ত্যাগের আনন্দ ও উৎসর্গের আনন্দ। শুধু ভোগে নয়, ত্যাগের মধ্যেও আনন্দ ও সুখ আছে। দিনটি এই শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত সুখ আর আনন্দের ঠিকানা সম্পদে নয়, ভোগে নয় বরং ত্যাগে। মানুষের যা কিছু আছে তা অন্যের জন্য, ত্যাগের মাধ্যমেই প্রকৃত সুখ।
আরবি ‘আউদ’ শব্দ থেকে ‘ঈদ’ শব্দের উৎপত্তি। এটি সাধারণত দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়- ১. আনন্দ, খুশি। এ অর্থটি পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হাদিসেও এসেছে। ২. অপর অর্থ- বারবার হাজির হওয়া, ফিরে আসা প্রভৃতি।
ষষ্ঠ হিজরীতে ঈদুল আযহার প্রচলন। ঈদুল আযহা প্রতিবছর আনন্দের ও ত্যাগের পয়গম নিয়ে হাজির হয়। ঈদুল আযহাকে ঈদুল কবির অর্থ্যাৎ মহান ঈদ বলা হয়। আযহা শব্দ জুবেহ থেকে উৎপত্তি। জবেহ করা ক্রিয়াপদ, আর আযহা অর্থাৎ জুবেহ বিশেষ্য পদ যার অর্থ কোরবানি। কোরবান বা কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। এ শব্দটি কুবরের শব্দমূল থেকে উৎপত্তি। কুবরের অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য।
তাহলে ঈদুল আযহার অর্থ দাড়ায় কোরবানি বা উৎসর্গ বা ত্যাগের আনন্দ। আরবি আযহা শব্দের অর্থ ত্যাগ স্বীকার, কোরবানী প্রভৃতি। ঈদুল আযহায় আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগ ও কোরবানীর চেতনা ভাস্বর হয়ে ওঠে।
কোরবানি দেয়ার রীতিটি পৃথিবীর আদিকাল থেকেই চলে আসছে। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর সময়কালেও কোরবানির রেওয়াজ চালু ছিল। কোরবানি হযরত আদম (আ.) এর সুন্নত ও আদর্শ। সেসময় কোরবানিকৃত মাংস/দ্রব্য পাহাড়ের চূড়ায় বা কোন উচু স্থানে রেখে আসলে তা যদি আকাশ থেকে অগ্নিবর্ষিত হয়ে পুড়ে যেতো তাহলে কুরবানি আল্লাহ কবুল করেছেন বলে প্রতীয়মান হতো। হযরত আদম (আ.) এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের দেয়া কোরবানি থেকেই মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানির ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়। যখন তারা উভয়েই কোরবানি করেছিলেন- তাদের একজনের কোরবানি কবুল হলো ও অপরজনের কোরবানি কবুল হলো না। অবশ্য আমাদের উপর যে কোরবানির বিধান প্রচলিত হয়ে আসছে তা মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর আত্মত্যাগের ঘটনারই স্মৃতিবহ। যথার্থ আনুগত্য প্রদর্শন, তার সন্তুষ্টি ও মানব কল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করার জন্য ধর্মীয় অঙ্গীকার ঘোষণায় সামাজিক আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল আযহা উদযাপিত হয় সারা বিশে^। এ উৎসব আত্মবিশ্লেষন ও আত্মশুদ্ধিসহ পশুত্ব কোরবানির উৎসব, আত্মোপলদ্ধির মহান স্মারক। কোরবানি মহান রবের প্রতি আত্মসমর্পণের এক অনুপম নিদর্শন। কোরবানি আল্লাহ প্রেমের এক অনন্য উপমা।
মুসলমানদের জন্য অফুরন্ত খুশির বার্তা নিয়ে হাজির হয় দু’টি দিন- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সী মুসলমানদের জীবনে ঈদ হাজির করে আনন্দের বন্যা। এমনকি আমাদের দেশে অন্যান্য ধর্মের মানুষকেও ঈদের আনন্দ স্পর্ষ করে। মানবিক, সাম্য, ত্যাগ ও সহমর্মিতার বিষ্ময়কর ও অপরূপ আলোকপ্রভা এই ঈদের উৎসবে প্রকাশিত হয়, যা ইসলামের মাহত্ম্য ও সর্বজনীনতার প্রতীক।
পশু জবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালনার্থে নিজ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)কে কোরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এ ঘটনায় কোরবানীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরো বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রভুপ্রেমে প্রাণ উৎসর্গ করা একটা পূণ্যময় ইবাদত বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। কোরবানী এমন একটা মর্যাদাকর বিষয় যাতে রয়েছে একাধারে আত্মগঠন ও সুস্থ সমাজ গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদানাবলী। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে কোন ধরণের পার্থক্য নেই। পার্থক্য রয়েছে শুধু আল্লাহভীতির ক্ষেত্রে, সত্য ও অসত্যের মধ্যে, ঈমানদার ও বেঈমানের মধ্যে। এই দৃষ্টিকোন থেকেই তাৎপর্য অনুমেয়।
আল্লাহর সস্তুষ্টি অর্জনের বড় মাধ্যম হিসেবে ত্যাগ স্বীকার করাই হলো কোরবানি। প্রকৃত অর্থে নিজেকে আমৃত্যু আল্লাহর রাস্তায় সমর্পন করা। ইসলামী শরীয়তে মুসলিম জাতির জীবনটাই একটি কোরবানিতুল্য। এ কোরবানি হতে পারে জান, মাল, সম্পদ, সময়, স্বার্থ, ইচ্ছা ও পশুর কোরবানি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থত্যাগ, আত্মত্যাগ ও সম্পদত্যাগ -এটাই হলো কোরবানি। ঈদুল আযহার অর্থ নিছক পশু কোরবানি নয় বরং ত্যাগ ও উৎসর্গের অঙ্গীকার।
প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কোরবানির নিমিত্তে অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। দিনটি হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান স্মরণিকা। আল্লাহর তাআলার নির্দেশে তিনি স্বীয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন মক্কার মরু প্রান্তরে। মহান আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সংকল্পের দৃঢ়তা দেখে তার কোরবানি কবুল করেন এবং হযরত ইসমাইল (আ.) এর স্থলে একটি দুম্বা কোরবানি মঞ্জুর করেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা ও কোরবানিসহ বিভিন্ন পরীক্ষা, কন্টকাকীর্ন ও কঠিন রাস্তা অতিক্রম করতে হয়েছে।
প্রতিটি কালের স্তরে, কালের চাহিদা অনুযায়ী মুসলিম জাতি তার আদর্শ সামনে রেখে জাতির অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার প্রয়োজনে কোরবানি দেন। কোরবানির পশু জবাই আসলে প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহপাক নিজেই বলেছেন- পশুর গোশত, চামড়া, রক্ত কিছুই তার নিকট পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তাকওয়া ও পরহেজগারী।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপনের ফসলই হল কোরবানি। কোরবানি শুধুমাত্র একটি আনন্দ উৎসব নয়। এর সাথে জড়িত রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ও দর্শন। ঈদুল আযহা আত্মোৎসর্গের প্রেরণায় উজ্জীবিত এক অনন্য সাধারণ আনন্দ উৎসব। কোরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে হযরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত এবং সর্বযুগের মানুষের জন্য অনুস্মরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। শুধু পশু নয়, প্রয়োজনে পশুত্বের কোরবানি দিতে হবে। প্রতিটি মানুষের ভিতর একটি হিং¯্র পশু আছে, যেটা আমাদের প্রতিনিয়ত অন্যায় ও পাপ কাজে উৎসাহিত করে থাকে এবং আত্মাকে পাপিষ্ট আত্মায় পরিণত করে। পশুত্ব হলো অপরিচ্ছন্ন শত কালিমাময় আত্মা অর্থাৎ পাপিষ্ট আত্মা। মানুষের আন্তরাত্মা পাপে ও গোনাহে ভরা, যেটার সম্মিলিত নাম পশুত্ব। সর্বপ্রথম এই পাপিষ্ট আত্মা অর্থ্যাৎ পশুত্বকেই কোরবানি করার পর পশু কোরবানি করা উচিত। হযরত ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করার আগে হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের জীবনকে কোরবানি করেছিলেন, সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পরিবার সারা মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ পরিবার। মুসলিম পরিবারের মধ্যে ধর্মীয়, নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শবোধ স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম পরিবারের মূল্যবোধের ভিত্তি হলো আল কোরআন ও সুন্নাহ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর আদর্শের তাত্বিক ও বাস্তবরূপ। প্রত্যেক মুসলিম পরিবারের সদস্যদের মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই হজ ও কোরবানি।
কিন্তু দু:খের বিষয় বর্তমান বিজাতীয় অপসংস্কৃতি এবং চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ আমাদের নৈতিক, আদর্শিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর চরম আঘাত হেনেছে। যার ফলে মুসলিম পরিবারের সদস্যরা আজ ভিন্ন ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করায় তাদের নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সর্বক্ষেত্রে পদদলিত। তাই হযরত ইব্রাহিম (আ.), বিবি হাজেরা এবং হযরত ইসমাইল (আ.) এর আদর্শ ও মূল্যবোধ আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত।
ঈদুল আযহা মানুষের জীবনে নিয়ে আসে স্বতন্ত্র আদর্শের প্রতীক। মানুষের ভক্তি, বিশ^াস ও আত্মোৎসর্গের শক্তি কত বৃহং রূপ নিতে পারে এই পবিত্র ঈদুল আযহার শিক্ষা, আদর্শ, তাৎপর্য ও বাস্তবতা তার প্রমাণ। যে মুসলমান ঈমানের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে নিজের পশুত্বকে কোরবানি করবে সেই কামিয়াবী এবং তার জন্য পরকালের অনন্ত জীবনে রয়েছে বেহেশত।
লেখক:
আলহাজ্ব প্রফেসর মো.আবু নসর
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড ও বরিশাল শিক্ষা বোর্ড।
সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ঢাকা।
মোবাইল নং-০১৭১৭-০৮৪৭৯৩
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন