ক্যাম্পাসে দ্যুতি ছড়াচ্ছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’
ক্যাম্পাসে দ্যুতি ছড়াচ্ছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’
শেখ শাকিল হোসেন
রাজধানীর আজিমপুর এলাকার একটি মেসে ভাড়া থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্রী। মেস মালিকের মানসিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন তারা। গেল ৬ এপ্রিল মেস মালিক ছাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার করে মাঝরাতে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে ঐ মেস মালিক অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করে এবং ফ্লাটে তালা লাগিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে মাঝরাতে আশ্রয়হীন অবস্থায় ছাত্রীরা ভীষণ নিরাপত্তাহীনতা পড়ে যায়।
কোন উপায় না দেখে ওই ছাত্রীরা বিষয়টি ঢাবির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’কে জানায়। সংগঠনটির প্রচেষ্টায় স্থানীয় পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মেস মালিককে কঠোরভাবে সতর্ক করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ ছাত্রীরা এখন নিরাপদে শান্তিপূর্ণভাবে মেসে অবস্থান করছে।
সংগঠনটির একাধিক সূত্র বলছে, প্রতিদিনই তারা শিক্ষার্থীদের থেকে অসংখ্য অভিযোগ পান। প্রতিষ্ঠার মাত্র ৯ মাসে সংগঠনটি শিক্ষার্থীদের ৩০০ টিরও বেশি অভিযোগের সুরাহা করেছে। যার অধিকাংশই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সাইবার বুলিং, ইভটিজিং, ব্লাকমেইলিং, স্থানীয় বিরোধ, জমি সংক্রান্ত সমস্যা, অন্যায়ভাবে হামলা, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত জটিলতা, ছিনতাই এবং শিক্ষার্থী হয়রানি সংক্রান্ত বিষয়। এছাড়াও সংগঠনটি বিভিন্ন মানবিক আবেদনে সাড়া দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। আর্থিক সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশনি ও পার্ট-টাইম জবের ব্যবস্থা করছে। কোভিড-১৯ এর কারণে দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষার্থীরা ঘরবন্দী। এসময় শিক্ষার্থীরা মানসিক বিষন্নতার কারণে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তও নিচ্ছে। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’ তাৎক্ষণিকভাবে এসব শিক্ষার্থীদের উদ্ধারের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করছে।
সবাই মিলে গড়ি নিরাপদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ২০২০ সালের ২২ জুন প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপদ মঞ্চ’। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়াস সিজার তালুকদার বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতা একটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছিল এবং খুনের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়ানোর কোন প্লাটফর্ম ছিল না বলেই শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ করতে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা জনিত প্রয়োজনে তাদের পাশে দাড়ানো ছাড়া সংগঠনটির আর কোন উদ্দেশ্য নেই।
কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ফেসবুকে তৈরি করা হয়েছে একটি গ্রুপ, যেখানে হয়রানির শিকার হওয়া শিক্ষার্থী অভিযোগ করতে পারবেন। অভিযোগের ভিত্তিতে মিলবে সমাধান। ঢাবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী যারা প্রশাসনের সাথে যুক্ত রয়েছেন এবং সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবকদের পারস্পরিক প্রচেষ্টায় ঢাবি পড়ুয়াদের যে কোনো প্রকার বৈধ আইনি ও প্রশাসনিক সহায়তা প্রাপ্তি ত্বরান্বিত হচ্ছে। সংগঠনটির কাজ আরো ফলপ্রসূ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে চারটি টিম। প্রশাসনিক সহায়তা টিম, আইন সহায়তা টিম, সাইবার সিকিউরিটি টিম এবং নারী নিরাপত্তা টিম।
ইতোমধ্যে, টিএসসি থেকে অপহৃত ফুল বিক্রেতা শিশু জিনিয়াকে উদ্ধার অভিযানের মূল নায়ক এবং ক্যাম্পাসের এক ছাত্রীকে হ্যারাসমেন্ট করা দুষ্কৃতকারী ও মাদকাসক্তকে পুলিশে সোপর্দ করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন সংগঠনটি সহ-প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত চৌধুরী।
একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে নিজের এলাকায় স্থানীয় অসাধু ও প্রভাবশালী লোকদের দ্বারা প্রতিহিংসাবশত অন্যায়ভাবে হামলা, নিপীড়ন ও নির্যাতন এবং সহিংসতার শিকার হয়ে আসছিল। এরই প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নায্য আইনি ও প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’ গড়ে তুলি। আইনি ও প্রশাসনিক সহায়তার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধনের সেতু হিসেবেও কাজ করছে নিরাপত্তা মঞ্চ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই সুবিধার অপব্যবহার করতে পারে, এমন শঙ্কার জবাবে তিনি বলেন, আমাদের এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে কেউ যেন কোন ব্যক্তিগত অসৎ উদ্দেশ্য বা স্বার্থ হাসিল করতে না পারে সেজন্য আমরা কোন সহায়তা প্রদানের পূর্বে প্রতিটি অভিযোগের সত্যতা যাচাই করি। এরপর ঘটনার সত্যতা অনুযায়ী আইনি সহায়তা প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকি। তবে দু:খজনক হলেও সত্য যে, কিছু মানুষ তাদের ব্যক্তিগত অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমাদের এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল এবং আমরা তা সত্যতা যাচাইয়ের পর অসংগতি ও হীন আকাঙ্ক্ষা খুঁজে পেয়ে তাকে সহায়তা প্রদানে নাকচ করে দিই এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকান্ডের পুনরাবৃত্তি না ঘটানোর জন্য কঠোরভাবে সতর্ক করে দেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, ‘নিরাপত্তা মঞ্চ’ আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা ও ভরসা জিতে নিয়েছে। ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শাহানাজ পারভীনের বলেন, ‘নিরাপত্তা মঞ্চ’ ঢাবির শিক্ষার্থীদের বটবৃক্ষের মত নিরাপত্তার ছায়ায় আচ্ছাদিত করে রেখেছে। আমরা আজকে মনে করি যে আমাদের যেকোন সমস্যা দেখা দিলে সেটির সমাধান সম্ভব। কেবলমাত্র এই প্ল্যাটফর্মের কারণে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্য ও প্রগাঢ় ভ্রাতৃত্ববন্ধন অনুভব করতে পারি। সংগঠনটি আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীর কাছে আস্থা, ভরসা ও স্বস্তি বোধের জায়গা। সমাজকল্যান ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত অভি বলেন, নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় ভুগতে থাকা ঢাবির যে কোন শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানে পরিবারের সদস্যদের ন্যায় পাশে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ। খুব কম সময়ে এই প্ল্যাটফর্মটি শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে আস্থা অর্জন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের। সংগঠনটির এই মহৎ কাজের জন্য আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে গর্ববোধ করছি।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সংগঠনটি শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের সমস্যার সমাধান, বিপদে পাশে দাঁড়ানো ও মানবিক প্রয়োজনে এগিয়ে এসেছে। যার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠনটি।
শেখ শাকিল হোসেন,
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ও
সভাপতি, সাতক্ষীরা স্টুডেন্ট সোসাইটি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন