ক্ষুধায় দিশেহারা ওরা খোঁজে মা-বাবাকে
পাঁচ বছরের শিশু মোহাম্মদ নবী। প্রায় সাত দিন অনাহারে থেকে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। তার বড় তিন ভাই-বোন ইউসুফ নবী (১০), রোজিনা বিবি (১২) ও নূর নবী (১৫)। তারাও ক্ষুধায় দিশাহারা। একই মায়ের সন্তান এই চার শিশু-কিশোর। তারা জানে না, তাদের মা-বাবা এখন কোথায় আছেন।
তাদের ছোট চাচা সুরত আলম বলেন, আমার বড় ভাই (চার শিশু-কিশোরের বাবা) শামসুল আলমকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী টুকরো টুকরো করে কেটে হত্যা করেছে। আমার বৃদ্ধ মা-ও এখনো জানেন না, বড় ভাই আর বেঁচে নেই। তাঁর সন্তানরা যেভাবে মা-বাবাকে খুঁজছে, তেমনি আমার মা-ও ছেলের অপেক্ষায় রয়েছেন।
এ সময় শিশু মোহাম্মদ নবীকে তার মা-বাবা কোথায় জানতে চাইলে এই প্রতিবেদকের মুখের দিকে কেবল তাকিয়ে ছিল। কিছু বলতে পারেনি।
তখন তার চাচা বলেন, নবী মা-বাবাকে শুধু খোঁজে। আর আমরা শুধু বলি, তোমার আব্বু তোমার আম্মুকে নিয়ে আসবে। মা-বাবার খোঁজে খাবারদাবারও ঠিকমতো খাচ্ছে না। এখানে আসার সময় প্রায় সাত দিন কিছু খেতে পারেনি। দুর্বল হয়ে গেছে।
নবীর পাশে থাকা তার বড় বোন রোজিনা বিবি বলে, আমরা এখানে (কুতুপালং) আসার সময় আমার বড় ভাইকে (নূর নবী) খুঁজতে গিয়েছিল আব্বু। কিছুক্ষণ পর বড় ভাই এলেও আব্বুকে আর দেখিনি। দুই চাচার সঙ্গে আমরা এখানে এসেছি।
নিহত শামসুল আলমের বড় ভাই নূর আলম বলেন, ছয় মাস আগে আমার ছোট ভাইকে সেনাবাহিনী বাড়িতে খুঁজতে এসেছিল। তাকে না পেয়ে তার স্ত্রী রেহেনা বেগমকে (৩০) সেনাবাহিনী ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে রাখাইনের বুটিটং জেলখানায় পাঠিয়েছে। ওই জেলখানা আমাদের বাড়ি থেকে ৫০ কিলোমিটারের বেশি হবে। শুনেছি তাকে ১২ বছর সাজা দিয়েছে। বাড়ি থেকে উঠিয়ে নেওয়ার পর থেকে সন্তানরা মাকে দেখেনি এবং মা-ও সন্তানদের দেখেনি। আমরা দেখতে চাইলেও কারাগার থেকে আমাদের সেখানে দেখতে যেতে দেয়নি।
পালিয়ে আসার ঘটনা বলতে গিয়ে নূর আলম বলেন, গত সোমবারের আগের সোমবার সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এরপর ওই রাতেই শামসুল তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখানে আসার জন্য রওনা হয়েছিল। কিছু দূর আসার পর গুলির শব্দ শুনে বড় ছেলে (নূর নবী) সেখান থেকে কোথাও চলে গেলে তাকে খুঁজতে গিয়ে শামসুল আর ফেরেনি। তার ছেলে কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে আমাদের সঙ্গে। আমরা সীমান্তের কাছাকাছি এসে পাঁচ দিন পর স্থানীয়দের কাছে শুনেছি, শামসুলের লাশ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ে আছে।
মা-বাবা ছাড়া চাচাদের সঙ্গে আসা এই চার শিশু-কিশোরের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকার। এ সময় তিন ভাই-বোনকে দেখা গেলেও নূর নবী ত্রাণ সংগ্রহ করতে পাশে (কুতুপালং বাজার) গেছে। কুতুপালং ব্রিজের পাশে খালসংলগ্ন ঝুপড়িতে চাচাদের সঙ্গে রয়েছে ওই চার শিশু-কিশোর। তাদের চোখে-মুখে কেনো উচ্ছলতা ছিল না। একেবারে চুপচাপ। ওই তিন ভাই-বোন শুধু তাকিয়ে আছে।
বালুখালী এলাকায় অবস্থান করা গুলশান আরা (২৫) নামে এক রোহিঙ্গা গৃহবধূর স্বামী দেড় বছর ধরে জেলে। তাঁকেও মিথ্যা মামলা দিয়ে সেনাবাহিনী জেলে পাঠিয়েছে বলে জানান স্ত্রী গুলশান আরা। মৃত্যুর হাত থেকে দুই শিশুসন্তান নূর কায়দা (৪) ও জাহাঙ্গীর আলমকে (৭) নিয়ে গুলশান আরা এক সপ্তাহ আগে কুতুপালং আসেন। গত বুধবার দুপুরে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি এখন এই দুই সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাব? অনেক কষ্টে সন্তানদের নিয়ে এখানে এসেছি।
উখিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে কুতুপালং বাজারে আসার পথে রাস্তার পাশে অবস্থান নেওয়া নারু বেগম (৩৪) নামের অন্য এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, আমার স্বামী হামিদুল্লাহকে ৯ মাস আগে গুলি করে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী। ওই দিন থেকে আমি ছয় মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় আশ্রয় নিয়েছি। বাচ্চার বাবাকে যেদিন গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, সেদিন সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে দৌড়ে পালিয়ে গেছে মেয়ে রহিমা খাতুন (১৯)। তাকে আর পাইনি। ওই ঘটনার ১৮ থেকে ২০ দিন পর আমার মেয়ে যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই বাড়িতে সেনাবাহিনী ঢুকে নির্যাতন করে সবাইকে হত্যা করেছে। আমার মেয়েকেও মেরে ফেলেছে।
নূর আলম (২২) মংডু গোরখালী থেকে হাতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাঁচ দিন আগে কুতুপালং আসেন। তাঁর ডান হাতে একাধিক গুলির জখম রয়েছে। গত বুধবার দুপুরে তিনি বলেন, গত ২৬ আগস্ট আমাদের এলাকায় যখন গোলাগুলি হচ্ছিল তখন সন্ধ্যা। ওই সময় ঘর থেকে পালিয়ে যেতে দৌড় দিলে গুলি এসে আমার এই হাতে লাগে। সেখানে ১৫ দিন চিকিৎসা করতে পারেনি। নদী, খালের পাড় ও পাহাড়ি এলাকা ঘুরে এখানে (কুতুপালং) এসেছি। এখানে আসার পর কুতুপালং চিকিৎসা ক্যাম্পে গেলে চিকিৎসক ড্রেসিং করে দিয়ে ওষুধ খেতে বলেছেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন