খাগড়াছড়িতে লোগাঙ গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে সমাবেশ ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে লোগাঙ গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে সমাবেশ ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেছে ২টি সংগঠন। পার্বত্য চট্টগ্রামকে বধ্যভূমি বানানো যাবে না” শ্লোগানে লোগাঙ গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে জেলাতে সমাবেশ ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন(এইচব্লিউএফ)।
গত বৃহস্পতিবার(১০ই এপ্রিল ২০২৫) বিকেল ৪টায় খাগড়াছড়ি সদরের চেঙ্গী স্কোয়ারে সমাবেশ করা হয়। এরপর সন্ধ্যায় স্বনির্ভরে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।
সমাবেশে পিসিপি’র অনিমেষ চাকমা সঞ্চালনায় ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের খাগড়াছড়ি জেলা শাখা আহ্বায়ক এন্টি চাকমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতি কণিকা দেওয়ান, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা ও বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি’র) সভাপতি অমল ত্রিপুরা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতি কনিকা দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সরকারের সময়ে যেমন গণহত্যাসহ নানা ঘটনা অব্যাহত ছিল, আজকে অন্তবরতীকালীন সরকারের সময়ে একই অবস্থা বিরাজমান।
পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। তিনি পাহাড়ে চলমান নিপীড়ন—হয়রানির ঘটনা তুলে ধরে বলেন, অপারেশনের নামে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারী নেতা—কর্মীদের নামে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে, মা—বোনদের হয়রানি করা হচ্ছে, তল্লাশির নামে লুটপাট চালানো হচ্ছে।
তিন গত ৭ই মার্চ রাঙামাটির কাউখালীতে সেনাবাহিনী—মুখোশরা মিলে গ্রামবাসীদের ঘরবাড়িতে তল্লাশি, মা—বোনদের হয়রানি ও লুটপাটের ঘটনা তুলে ধরেন এবং বলেন এসব ঘটনায় প্রমাণ করে অতীতের সরকারগুলোর সাথে বর্তমান অন্তবরতীকালীন সরকারের কোন পার্থক্য নেই। তিনি লোগাঙ গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত সংঘটিত সকল গণহত্যার বিচার দাবি করেন।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উস্কানিতে বহুবার সা¤প্রদায়িক হামলা ও গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে।
বর্বরোচিত লোগাঙ গণহত্যা’র ঘটনা সারাবিশ্বে আলোচিত একটি ঘটনা। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সংঘটিত এ ঘটনায় ১২শ’র অধিক মানুষ হত্যার শিকার হয়। ৭শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নারীদের ধর্ষণ—নির্যাতন করা হয়।
কিন্তু এ ঘটনার সঠিক রিপোর্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তিনি গত বছর স্বনির্ভরে সেনাবাহিনী কর্তৃক জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরাকে হত্যার ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি লোগাঙ গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেসব ঘটনার শ্বেতপত্র প্রকাশপূর্বক বিচার ও জড়িতদের শাস্তি প্রদানের দাবি জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি’র) সভাপতি অমল ত্রিপুরা বলেন, স্বাধীনতা পর শেখ মুজিব পাহাড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের ওপর নিপীড়ন—নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। কলমপতি গণহত্যা থেকে শুরু করে লোগাঙ, লংগদু, নান্যাচরসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সেটলার কর্তৃক ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।
লোগাঙ গণহত্যার ৩৩বছরেও ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্র কোন ব্যবস্থা নেয়নি, বিচার করেনি। লোগাঙ গণহত্যার বিচার না হওয়ায় এটাই প্রমাণ করে যে পাহাড়িদের ওপর হামলা, হত্যাকান্ড ঘটানো হলেও বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না, শাস্তি পেতে হয় না। এই রাষ্টে্রর আইন ও বিচার ব্যবস্থা জাতিগত নিপীড়নকারীদের রক্ষা করে, সহযোগীতা করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে বধ্যভূমি করার ষড়যন্ত্র চলছে মন্তব্য করে অমল ত্রিপুরা বলেন, অব্যাহত খুন—গুম, সা¤প্রদায়িক হামলা, গণহত্যার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বধ্যভূমি বানানো ষড়যন্ত্র করছে রাষ্টে্রর একটি বিশেষ মহল।
তারা ১৯৮০সালের ২৫শে মার্চ কাউখালী কলমপতিতে গণহত্যা করেছিল, ১৯৯২সালে লোগাঙে গণহত্যা করেছিল এবং ২০২৪সালে জুলাই অভ্যুত্থানে পর সেপ্টেম্বর ৪জনকে হত্যা করেছিল। বান্দরবানে বম জাতিসত্তাদের ওপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পূর্বে পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যেভাবে নিপীড়ন, নির্যাতন, গণহত্যা চালিয়েছে, মা—বোনের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে একই কায়দায় নব্য পাক বাহিনী ও তাদের দোসররা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়ন—নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। কাজেই সকলকে এ বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
সমাবেশ থেকে তিনি, লোগাঙ গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল গণহত্যার শ্বেতপত্র প্রকাশপূর্বক বিচারের দাবি জানান। এছাড়া কারাবন্দী নিরপরাধ বম জাতিসত্তাসহ রাজবন্দিদের মুক্তি ও পাহাড়ে নিপীড়ন বন্ধ করে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে অন্তবরতী সরকারে প্রতি আহ্বান জানান।
এছাড়াও তিনি ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিন জনগণের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে এ হামলা ও গণহত্যা বন্ধেরও দাবি জানিয়েছেন।
এন্টি চাকমা বলেন, পাহাড় এবং সমতলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার উপর হামলা আগের তুলনায় বর্তমানে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। সেনাবাহিনী পাহাড়ে অস্ত্র উদ্ধারের নামে ছাত্র—তরুণদের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে হয়রানি করে যাচ্ছে।
বিভিন্ন সরকারি—বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গোয়েন্দা নজরদারী রেখে শিক্ষার্থীদের চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত উদীয়মান নেতৃত্ব ছাত্র—যুব নেতাদের চিন্তিত করে হত্যা করা হচ্ছে।
সেনা—সেটলার কর্তৃক পাহাড়ে সা¤প্রদায়িক হামলা এখনো চলমান রয়েছে। গত বছর ১৯—২০শে সেপ্টেম্বরে সেনা—সেটলাররা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পর পর সা¤প্রদায়িক হামলা চালিয়ে চার জনকে হত্যা করে।
তিনি বলেন, অতীতের সরকারগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত গণহত্যাগুলোর বিচার করেনি। বর্তমান অন্তবরতীকালীন সরকারকে অতিদ্রুত এসব গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ বিচার ও শাস্তি দিতে হবে।
সমাবেশে পর চেঙ্গী স্কোয়ার থেকে মিছিল সহকারে গিয়ে সন্ধ্যায় স্বনিভর বাজারে শহীদ অমর বিকাশ সড়কের চৌরাস্তা মোড়ে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। এতে দুই শতাধিক নারী—পুরুষ, শিশু—কিশোর অংশগ্রহণ করেন।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন