খাগড়াছড়িতে সহিংস ঘটনাবলীর ওপর গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট প্রকাশ
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে সহিংস ঘটনাবলীর ওপর গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। গত ২৩শে সেপ্টেম্বর মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনার পরবর্তী খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও গুইমারায় সংঘটিত সহিংস ঘটনাবলী তথ্যানুসন্ধানের পর গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি একটি তথ্যানুসন্ধান রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
কমিটির ফেসবুক পেজে গত বৃহস্পতিবার(৩০শে অক্টোবর ২০২৫) প্রকাশ করা রিপোর্টেও প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলা হয়েছে, “গত ২৩শে সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে একটি মারমা কিশোরী মেয়ের ধর্ষণকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে সাধারণ নাগরিকের উপর নিপীড়ন করা হয়।
এতে তিনজন মারমা যুবককে হত্যা করা হয় এবং প্রচুর দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্থ হয়। উদ্ভুত এই ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য গত ৯ই অক্টোবর গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষ থেকে একটি নাগরিক দল খাগড়াছড়িতে তথ্যানুসন্ধানের জন্য অবস্থান করে। তথ্যানুসন্ধানে যাওয়ার পূর্বে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়।
উল্লেখ্য, তথ্যানুসন্ধানের ঘোষনা দেয়ার পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে নানারকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্যদের পক্ষে এই তথ্যানুসন্ধান দলে ছিলেন: ড: হারুন উর রশীদ, সত্যজিত বিশ্বাস, আবদুল্লাহ কাফী রতন, মোশরেফা মিশু, নজরুল ইসলাম, সায়েদুল হক নিশান, রজত হুদা এবং মারজিয়া প্রভা।
উল্লেখ্য যে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির এই তথ্যানুসন্ধান চলাকালে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দলও উপদ্রæুত এলাকা পরিদর্শন করেন।
“প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে ধর্ষণের ভুক্তভোগী মারমা কিশোরী ও তার পরিবার, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন, জাতীয় আইনগত সংস্থা, স্বনির্ভর ও রামসু বাজারের ক্ষতিগ্রস্থ দোকানদার, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী এবং গুইমারার নিহত তিনজনের পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়।”
রিপোর্টে গত ২৩শে সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি পৌরসভার সিঙ্গিনালায় মারমা কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা থেকে শুরু করে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার তথ্যাবলী টাইমলাইন আকারে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রকাশিত রিপোর্টে তথ্যানুসন্ধান প্রতিনিধি দলের পর্যবেক্ষণমূলক যে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে তা নিন্মরূপ: তথ্যানুসন্ধান পর প্রতিনিধিদলের বক্তব্য: ১। ভুক্তভোগীর পরিবার এখনো আতংকে:-গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষ থেকে আমরা প্রথমেই ধর্ষণের শিকার মারমা কিশোরীর বাসা(সিংগিনালা)তে যাই।
সেখানে গিয়ে প্রথমে ভুক্তভোগীর পরিবার আমাদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলো না। এর কারণ তারা জানিয়েছিলো যে, এর পূর্বে খাগড়াছড়িতে বিভিন্ন সাংবাদিক এসে তাদের ভিডিও করা, জোর করে কথা বলানো এবং ভুক্তভোগীর মেয়ের পরিচয় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলো। যার কারণে ভুক্তভোগী পরিবার শংকাবোধ করছে এবং তাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করেছে।
২। ওসি কর্তৃক ধর্ষণের ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছ থেকে ডিসচার্জ রিপোর্ট ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা, পরিবারকে দেওয়া হয়নি প্রেসক্রিপশন:-ধর্ষণের ঘটনার পরেই যখন রক্তাক্ত অবস্থায় ফসলের ক্ষেত থেকে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়, তখনই তাকে অচেতন অবস্থায় খাগড়াছড়ি আধুনক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিনই রাত ১২টায় ভুক্তভোগির মেডিকেল টেস্টের জন্য আলামত সংগ্রহ করা হয়।
পরদিন সকালে মেডিকেল টেস্ট করার জন্য গাইনোকলজিস্ট বিশেষজ্ঞ জয়া চাকমা আসে এবং পুলিশ মেয়েটির জবানবন্দি নেয়। মেয়েটির ক্ষত স্থান নিরাময়ের জন্য মলম ও ব্যাথার ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু ২৫শে তারিখ হাসপাতাল থেকে মেয়েটিকে ডিসচার্জ ফরম দেবার পরে ওখানে অবস্থিত ওসি(পুলিশ সদস্য) মেয়েটির পরিবারের কাছ থেকে ডিসচার্জ রিপোর্ট কেড়ে নেয়।
এমনকি সেটার ছবিও তুলতে দেয়নি। এমনকি ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছে কোন প্রেসক্রিপশন, মেডিকেল টেস্ট রিপোর্ট কিছুই দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ মেয়েটির পরিবারের কাছে হাসপাতাল থেকে প্রদান করা মেডিকেল ডকুমেন্টস নেই এবং ডিসচার্জ ফরম ওসি কেড়ে নিয়ে গেছে।
৩। ধর্ষণের আলামত পরীক্ষার রিপোর্ট আগে প্রকাশ করে একটি টিভি চ্যানেল, পরে জানানো হয়েছে পরিবারকে ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা জানতে পারি, মেডিকেল টেস্টের আলামত প্রতিবেদন তারা যমুনা টিভির প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানে। প্রকাশিত সংবাদের পরদিন ওসি এসে তাদেরকে পরীক্ষার রেজাল্ট জানায়।
৪। অভিযুক্ত একজন পূর্বেই ধর্ষণের ভুক্তভোগীকে স্কুলে যাওয়ার পথে যৌন হয়রানি করতো অভিযুক্ত ও গ্রেফতারকৃত সয়ন শীল পুর্বেই ভুক্তভোগীকে স্কুলে যাবার পথে নানাবিধভাবে যৌন হয়রানি করতো বাজে ইঙ্গিতের মাধ্যমে। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আমাদের বলা হয়, মারমা কিশোরীর ধর্ষণের ঘটনায় বিচার চেয়ে আন্দোলনের প্রথমার্ধে নয়ন শীলের গ্রেফতার চাওয়া হয় এবং পরবর্তীতে সয়ন শীলের গ্রেফতার চাওয়া হয়।
এই বক্তব্য আমাদেরকে ম্যানুপুলেটিভ করার জন্য বলা হয়েছে বলে মনে করি। কারণ ভুক্তভোগীর কাছ থেকে আমরা সয়ন শীলের নামটাই শুনে এসেছি। জ্ঞান ফেরার পরে ভুক্তভোগী তাকেই চিহ্নিত করতে পেরেছিলো।
৫। ধর্ষণের আলামত নিয়ে একটি টিভি চ্যনেলের প্রপাগান্ডা: আলামতের পরীক্ষায় সূচক থাকে ত্রিশটি, তারা ১০টা সূচক দিয়ে রিপোর্ট করেছে।
যমুনা টিভিতে প্রকাশিত সংবাদ জানিয়েছে যে মেডিকেল পরীক্ষার ১০টি সূচকে আলামত পাওয়া যায়নি। সিভিল সার্জন মারফত আমরা জেনেছি যে, মেডিকেল পরীক্ষায় ৩০টি সূচক থাকে। তবে যমুনা টিভি কোন ১০টি সূচকের কথা বলেছে তা তিনিও জানেন না। মেয়েটি পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে বলেছে তার যোনিপথে রক্ত থাকার কারণেই তাকে প্রথমে কবিরাজ এবং পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এছাড়াও তার শরীরের উপরিভাগে ক্ষত থাকার জন্য তাকে মলম প্রদান করা হয়েছে। সিভিল সার্জন আমাদের জানিয়েছে যে তাদের রিপোর্টে ‘ঝরমহ ড়ভ হড় ভড়ৎপবভঁষ ংবীঁধষ রহঃবৎপড়ঁৎংব’ বলা হয়েছে। কিন্তুু যোনিপথে রক্ত এবং শরীরের ক্ষত কেন ফোর্সফুল সেক্সচুয়াল ইন্টারকোর্সের চিহ্ন হবে না তার কোন সদুত্তর তিনি দেননি।
এক্ষেত্রে আমাদের সাথে থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডঃ হারুন উর রশীদ জানিয়েছেন, মেডিকেল জুরিসপ্রæুডেন্স হিসেবে ‘গবৎব ঃড়ঁপয ড়ভ াধষাব’ কেই ধর্ষণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই বাদে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আমাদের জানিয়েছে, ‘অবিবাহিত বা সেক্সুয়াল এক্সপোজ না হওয়া কোন নারীর জন্য, বডিতে সিমেন(বীর্য) না থাকলে, ফরেনসিকে তার সাথে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স প্রমাণ করা কষ্টকর।
৬। ফরেনসিক পরীক্ষার পরে ডিএনএ টেস্ট এখনো বাকি:-সিভিল সার্জন জানিয়েছেন, ফরেনসিকের পাশাপাশি ডিএনএ টেস্টের জন্য সোয়াব সংরক্ষণ করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। তাই কেবল ফরেনসিকের ভিত্তিতে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়নি এই সরলীকরণ একটি ম্যানুফেকচার্ড প্রোপাগান্ডা।
৭। কিভাবে ধর্ষণের আলামত টেস্টের রিপোর্ট মিডিয়ার হাতে গেলো? নারী নির্যাতন দমন আইন ২০০০অনুযায়ী, ভুক্তভোগীর নাম প্রকাশ একটি আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আমরা দেখেছি যমুনা টিভি ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশ করে তার ধর্ষণের আলামত টেস্টের রিপোর্ট প্রচার করেছে। কিভাবে এই রিপোর্ট মিডিয়ার কাছে গেলো তা আমরা সিভিল সার্জন এবং পুলিশ সুপারের কাছে জানতে চেয়েছি।
সিভিল সার্জন জানিয়েছেন, ২৯শে সেপ্টেম্বর তারিখ সকাল ১১টায় এ তাঁর কাছে রিপোর্ট আসে, এই রিপোর্ট সিলগালা করে তিনি ১১:১০এ তিনি পুলিশ সুপারের কাছে দেন। তিনি জানান, খাগড়াছড়ি জেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে এই রিপোর্ট মিডিয়ার কাছে যায় নি। এমনকি তাঁকে মিডিয়া থেকে অসংখ্যবার ফোন দিলেও তিনি ধরেন নি।
তবে নিয়মানুযায়ী পুলিশ সুপারের কাছে দায় বর্তায়। পুলিশ সুপার প্রথমে সিভিল সার্জনকে দায়ী করতে চাইলেও, পরে ওখানে উপস্থিত জানায় যমুনা টিভি হয়ত কোন মুন্সির কাছ থেকে এই রিপোর্ট পেয়েছে। আমরা দেখতে পেয়েছি, কেউই এর সদুত্তর দিতে পারছে না যে কার কাছ থেকে এইরকম অতি কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট পাচার হয়েছে। তারা একে অপরের গায়ে দোষ দিয়েছে কিন্তু চিহ্নিত ব্যক্তিটিকে এখনো খুঁজে বের করেনি।
৮। ‘স্বনির্ভর বাজারে বহুবছর যাবৎ বাঙালি এবং আদিবাসী দোকানদার ব্যবসা করে, কিন্তু কখনও এরূপ লুটপাট ও ভাংচুর হয়নি’-ক্ষতিগ্রস্থ বাঙালি দোকানদার প্রায় ১৩টি বাঙালি দোকানের মধ্যে স্বনির্ভর বাজারে ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে ধর্ষণবিরোধী অবরোধের সময় ৬টি দোকান লুটপাট করা হয়।
এইসময় কেউই দোকানে ছিলো না। দোকানগুলোর মধ্যে আছে মুদির দোকান, মোবাইল যন্ত্রপাতির দোকান, পোশাকের দোকান এবং হোটেল। আমরা প্রতিটি দোকানে ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলেছি, তারা জানিয়েছে এর আগে কখনোই স্বনির্ভর বাজারে এই ধরণের লুটপাট ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেনি। উল্লেখ্য স্বনির্ভর বাজারের কাছেই পুলিশ চেকপোস্ট। তবে পুলিশের উপস্থিতিতে এই ভাংচুর কিভাবে হয় তা এলাকাবাসীর প্রশ্ন।
তা বাদেও এলাকাবাসী কেন এখনো চিহ্নিত অপরাধীকে ধরা যাচ্ছে না তা নিয়ে সন্দিহান। স্থানীয় অনেকে মনে করেন স্বনির্ভর বাজারের ঘটনা তৃতীয় কোন শক্তির ইন্ধনে করা হয়েছে। এই তৃতীয় শক্তি-কারা তা রাষ্ট্রকে বের করতে হবে। স্থানীয় জনতা জানায়, সেদিন স্বনির্ভর বাজারে পুলিশের উপস্থিতি ও নীরবতায় এই ঘটনা ঘটতে দেয়া হয়েছে।
সেনাবাহিনীর তরফ থেকে এক লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থদের, তাতে প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্থ বাঙালি দোকানদার ৮হাজার টাকা পেয়েছে। যা তাদের ৮-৯লাখ ক্ষতির কাছে খুবই অপ্রতুল।
৯। ঘটনাবলী সম্পর্কে জেলা প্রশাসকের বক্তব্য:-জেলা প্রশাসকের সাথে আমরা এক ঘন্টার একটি মিটিং করেছি। এই মিটিং এ আমাদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রশ্ন ছিলো। আমরা তাকে ধর্ষণের ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ডিসচার্জ ফর্ম কেড়ে নেওয়া এবং মিডিয়ায় ভুক্তভোগীর নাম প্রকাশ ও ধর্ষণ পরীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি এই ব্যাপারে নিন্দা প্রকাশ করেছেন এবং দেখবেন জানিয়েছেন।
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে সেনা মোতায়েন, ১৪৪ধারা জারি করা কেন হয়েছিলো? তিনি উত্তরে জানান, “আর্মি এবং পুলিশ খাগড়াছড়িতে কোলাবরেটেভলিভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। ধর্ষণবিরোধী অবরোধের সময় পুলিশ নিজেই আর্মি রিকুইজিশন দিয়েছিলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য”।
ভুমি সমস্যার প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এইটা দেশের টপ লেভেল, পলিসি লেভেল ইস্যু’। কিন্তু পাহাড়ি জাতিসত্তার ভুমির স্বকীয়তা বজায় রাখতে তারা একটা ডিজিটালাইজড উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের প্রতিনিধিদল প্রেরণের সংবাদ তাকে জানানো হয়েছিলো পূর্বে। এরফলে তার কাছে কোন একটি পক্ষ আমাদের আসার বিরোধিতা করে চিঠি দেয়। তিনি জানিয়েছিলে যে, আমাদের সেদিন ‘বিতর্কিতহীন অক্ষতভাবে ঢাকায় ফিরে যাওয়াটা চ্যালেঞ্জের’।
১০। ঘটনা সম্পর্কে সিভিল সার্জনের বক্তব্য:-সিভিল সার্জন জানিয়েছেন, ২৪শে স্পেটম্বও তারিখেই ভুক্তভোগীর আলামত সংগ্রহ করা হয়(২৪ ঘন্টার মধ্যে)। এবং সিভিল সার্জনকে রেখে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। এই কমিটিতে অন্যান্য দুইজন ছিলো ডাঃ জয়া চাকমা এবং ডাঃ নাহিদ। ডাঃ জয়া চাকমা জেন্ডার বেইজড ভায়োলেন্স সংক্রান্ত একজন মাস্টার ট্রেইনার বলে জানান সিভিল সার্জন।
তিনি কিভাবে রেপ ভিকটিম হ্যান্ডেল করতে হয় তা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে প্রশিক্ষিত এবং মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে অন্য গাইনোকোলজিস্ট ডাক্তারদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। তিনি ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখের মধ্যেই রিপোর্ট সম্পন্ন করেন। কিন্তুু কেন সেইটি প্রকাশ হতে ২৯শে সেপ্টেম্বর তারিখ লেগেছিলো সে ব্যাপারে সিভিল সার্জনের বক্তব্য হল এই যে, ডাঃ নাহিদের সন্তান অসুস্থ থাকার কারণে তিনি চট্টগ্রাম ছিলেন। তার সই ব্যতীত রিপোর্ট প্রকাশ করা যাচ্ছিলো না। ডাঃ নাহিদের সই নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ হতে ২৯শে সেপ্টেম্বর তারিখ পর্যন্ত সময় যায়।
এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর মামীর কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি জানিয়েছেন, “যদি রিপোর্ট এ ধর্ষণের আলামত নাই পাওয়া যায়, নেগেটিভ ই আসে তবে সেইটা আগে প্রকাশ হলে এতোগুলো মানুষ মারা যেতো না”। কেবলমাত্র একজন ডাক্তারের পেশাদারিত্বের অভাবে এইটি যে ঘটেছে তা সিভিল সার্জনও স্বীকার করেছেন।
১১। ভাইবোনছড়ায় ত্রিপুরা ভুক্তভোগীর ধর্ষণের বিষয়ে সিভিল সার্জন অবগত নন:-উল্লেখ্য, গত জুন মাসে খাগড়াছড়িতে ভাইবোনছড়ায় ৮ম শ্রেণীর এক ত্রিপুরা মেয়েকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। তার কোন মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়নি। ঢাকা থেকে প্রেরিত একটি নাগরিক দল পুলিশ সুপারকে অবগত করলেও এখনও পর্যন্ত ত্রিপুরা মেয়েটির মেডিকেল টেস্ট করা হয়নি।
এই প্রশ্নে সিভিল সার্জনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি অবগত নয় জানান। এখানে ভুক্তভোগীর পরিবার ও একটিভিস্টদের সাথে আলাপে আমরা জেনেছি, পাহাড়ে আদিবাসী নারীর ধর্ষণের ঘটনায় সচরাচর মেডিকেল টেস্ট হয় না। খাগড়াছড়িতে এখন পর্যন্ত কোন ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস নেই। সিভিল সার্জন জানিয়েছেন নতুন বিল্ডিং হলে ওয়ান স্টপ সেন্টার স্থাপিত হবে। তিনি চেষ্টারত।
১২। খাগড়াছড়ি জেলা জাতীয় আইন সহায়তা সংস্থা লিগ্যাল এইড:-খাগড়াছড়ি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে মারমা ভুক্তভোগির বিষয় নিয়ে আমরা সাক্ষাৎ করতে গিয়েছি। কিন্তু তারা প্রথমে দেখা করতে চান নি। আমরা জোরপূর্বক সাক্ষাৎ করলে অবগত হই যে, খাগড়াছড়ি জেলা লিগ্যাল এইড নাকি মারমা ভুক্তভোগী এবং পূর্বোক্ত ত্রিপুরা ভুক্তভোগী কিশোরীর ধর্ষণের ঘটনা জানেন না।
পরবর্তীতে আমাদের সাক্ষাতের ফলে তারা প্রতিপ্রæুতি দেন যে সবরকম আইনি সহায়তা তারা এই ঘটনা দুইটিতে দিবেন। পরবর্তীতে গত ১২ই অক্টোবর তাদের মারফত আমরা জানতে পারি যে, খাগড়াছড়ি ন্যাশনাল লিগ্যাল এইড মারফত একজন আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে এবং ভুক্তভোগীর সকল আইনি খরচ তারা বহন করবে। তবে এই বিষয়ে পুনর্বার ফলোআপের প্রয়োজন।
১৩। লাশ সৎকার নিয়ে হয়রানি এবং পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি:-২৮শে সেপ্টেম্বর ধর্ষণবিরোধী সমাবেশে প্রথমার্ধে শান্তিপূর্ণ অবরোধ ছিলো। সেনাবাহিনী এই অবরোধ নিয়ে অবগত ছিলো এবং জুম্ম ছাত্র জনতার আন্দোলনকারীকে জানিয়েছিলো তাদের শান্তিপূর্ণ অবরোধে তারা কোন বাঁধা দিবে না। কিন্তুু যখন অবরোধ শেষ হতে দেড় ঘন্টার মতো বাকি তখন হুট করে শান্তিপূর্ণ অবরোধ পালনকালেই সেনাবাহিনী অবরোধকারী ছাত্র জনতার ওপর বিনা উস্কানিতে হামলা চালালে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এভাবে হামলার সূত্রপাত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এলাকার পরিচিত সেটেলার বাহিনী লাঠি, দা নিয়ে মারামারি করতে আসে। সেদিন রামসু বাজারে সবাই দোকান বন্ধ রেখেছিলো। কিন্তু আক্রমণের সময়ে পাড়া বাঁচাতে মারমা সম্প্রদায়বাসী নেমে আসে। সেইসময় সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথবাহিনী গুলি ছুঁড়ে। এর ফলে তিনজন মারমা যুবক নিহত হন। তাদের নামঃ থোয়াইচিং মারমা(২৫), আখ্রক মারমা(২৪) এবং আথুইপ্রæু মারমা(২৬)। এরমধ্যে থোয়াইচিং মারমার স্ত্রী ৬মাসের গর্ভবতী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নিহতদের গুলি ছোঁড়ার পরেও তারা জীবিত ছিলেন। কিন্তু এরপর এলাকার পরিচিত সেটেলার বাঙালীদের উপর্যুপরি মারধোর প্রচন্ড আঘাতপ্রাপ্ত ও নিপীড়নের ফলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের মৃত্যু ঘটে। নিহত হবার পরে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হলে পরিবারের সদস্যদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে পোস্টমর্টেমের পর লাশের মুখ দেখতে দেওয়া হলেও পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়নি, বরং সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথবাহিনী নিজ উদ্যোগে মৃতদেহের সৎকার করে। এখন পর্যন্ত পরিবার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট প্রাপ্ত হয়নি।
এই গুলির ঘটনায় ১৬জন মারমা সম্প্রদায়ের মানুষ আহত হন। তাদের খাগড়াছড়ি জেলা কমপ্লেক্সে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। উলাপ্রæু নামক একজন মারমা ব্যক্তি আমাদেরকে তার গুলিবিদ্ধ পায়ের আহত স্থান প্রদর্শন করায়। গুইমারা একটি আশ্রয় কেন্দ্রের প্রধান ও বৌদ্ধ ভান্তে জ্যোতিছড়া[জ্যোতিসারা] জানান, আশ্রম বানানোর জন্য ৬০-৭০জন এলাকাবাসী কাজ করছিলেন সেদিন। রামসু বাজার প্রতিরক্ষার নিমিত্তে তারা কাজ ছেড়ে দৌড়ে যায়।
রামসু বাজারে ক্ষতিগ্রস্থ অন্তত ৮৫টি দোকান ও বাড়ি, পাঁচটি এনজিও অফিস এবং একটি হলুদ গুদাম। স্থানীয় সূত্রের মতে, প্রাথমিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫কোটি টাকা। (প্রতিবেদন, ১লা অক্টোবর ২০২৫)। রামসু বাজারে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পাহাড়ি এবং বাঙ্গালিরা উভয়ই। জেলা প্রশাসক পরিদর্শন করে গিয়েছে। তবে এখনও নিহত পরিবার এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার সরকারি পর্যাপ্ত পরিমান সহায়তা পায়নি।
১৪। গুইমারায় হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অজ্ঞাতনামায় ৩০০জন আসামী, মারমা সম্প্রদায় আতংকে:-গুইমারার হতাহত ঘটনাকে কেন্দ্র করে অজ্ঞাতনামায় ৩০০-৭০০জন কে আসামী করা হয়েছে। তাই গণগ্রেফতারের ভয়ে আছে গুইমারার সিংগুলি পাড়ার সাধারণ মানুষ। তারা জানিয়েছে প্রতি রাতে ড্রোন উড়িয়ে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। সেনাবাহিনীর ট্রপ সন্ধ্যা হলেই টহল দিচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়।
আমরাও ফিরতি পথে সেনাবাহিনীর টহল গ্রæুপ দেখেছি। রামসু বাজারে সেনাবাহিনীর ট্রপ দেখেছি। পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা এবং ‘সাংবাদিকবেশী’ সন্দেহভাজন ব্যক্তিবর্গ রামসু বাজারকে ঘিরে রয়েছে প্রতিনিয়ত।
১৫। কতিপয় সংবাদমাধ্যমের মিথ্যাচার:-গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি তদন্ত সেরে ফিরে আসার পর ১০ই অক্টোবর থেকে কতিপয় সংবাদমাধ্যম মিথ্যাচার করছে নানাবিধ সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে।
তারা জানাচ্ছে আমাদের দলটি বাঙালি ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে কথা বলেনি। এর মধ্যে পাহাড়ের খবর, সাউথ এশিয়ান জার্নাল উল্লেখযোগ্য। অথচ সত্য হলো, আমরা স্বনির্ভর বাজারে ক্ষতিগ্রস্থ ৬টি বাঙালি দোকান এবং রামসু বাজারে ক্ষতিগ্রস্থ নোয়াখালি রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির ক্ষয়ক্ষতি পরিদর্শন করেছি এবং বাঙালি ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলেছি। কিন্তু এই ধরণের সংবাদমাধ্যম ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সংবাদ কেন প্রকাশ করছে তা নিয়ে আমরা সন্দিহান।
রিপোর্টে তথ্যানুসন্ধান দলের পক্ষ থেকে ৭টি দাবি তুলে ধরা হয়েছে। দাবিগুলো হলো: ১। অবিলম্বে খাগড়াছড়ির ধর্ষণ ভুক্তভোগী মারমা কিশোরীর ডিসচার্জ ফর্ম পরিবারকে দিতে হবে, বাকি দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে হবে এবং ন্যায্যতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। এ মামলা কোনভাবেই যাতে দীর্ঘসুত্রায়িত এবং প্রভাবিত না হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
একইভাবে গত জুন মাসে ভাইবোনছড়ার ত্রিপুরা কিশোরীর ডিএনএ টেস্ট করানো এবং বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে স্বচ্ছ, প্রভাবমুক্ত, দ্রæুততর বিচারকার্য চালাতে হবে। বর্তমান সংশোধিত নারী নির্যাতন দমন ২০০০আইনের আওতায় ৯০দিনের মধ্যে এই মামলার নিস্পত্তি আমরা দাবি করছি।
২। অবিলম্বে সংশোধিত নারী নির্যাতন দমন আইন ২০০০এর আওতায় ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশের কারণে দায়ী টিভি চ্যানেলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কিভাবে মেডিকেল রিপোর্ট গণমাধ্যমের কাছে গেলো তা বাংলাদেশ পুলিশকে জনসম্মুখে তুলে ধরার দাবি জানাচ্ছি।
৩। গুইমারার হতাহতের ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
৪। গুইমারায় হতাহতের ঘটনার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে এবং লাশ সৎকার নিয়ে হয়রানি বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে হবে।
৫। নিহত মারমা পরিবার, স্বনির্ভর বাজার, য়ংন্ড বেীদ্ধ [য়ংড] বৌদ্ধবিহার, রামসু বাজার, মহাজনপাড়াসহ সকল ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ি এবং বাঙ্গালীদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৬। নিহত মারমা পরিবারের গর্ভবতী নারীকে চিকিৎসার খরচ দিতে হবে।
৭। গুইমারার অধিবাসীদের মিশ্র সেনা ও পুলিশ বাহিনী(পাহাড়ি-বাংগালী যৌথ মিশ্রন) নিরাপত্তা দিতে হবে। গণগ্রেফতার, মিথ্যা মামলা, হামলা, হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন




