খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক হামলার স্মরণে-প্রদীপ প্রজ্জ্বলন

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২৫ গুইমারাতে সেনা সেটেলার কর্তৃক গণহত্যায় শহীদ আখ্রক মারমা, থোয়াইচিং মারমা, আথুইপ্রæু মারমার স্মরণে-পৃথক ২টি স্থানে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেছে। সোমবার(৬ই অক্টোবর) সন্ধ্যায় প্রবারনা পুর্নিমা উপলক্ষে য়ংড বৌদ্ধ বিহার প্রাংগনে জুম্ম ছাত্র-জনতা মিডিয়া সেল এ আয়োজন করা হয়।

এদিকে খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক হামলা ও সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে নিহতদের স্মরণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দেলনের উদ্যোগে ৬ই অক্টোবর ২০২৫ বিকেল ৪টার সময়ে ঢাকার শাহবাগ প্রাঙ্গণে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন আয়োজন করা হয়।

এই সময়, খাগড়াছড়িতে একজন মারমা কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগে ৩জন নিহত ও অন্তত ৩০জন আদিবাসী আহত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে মর্মে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এবং পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধান উপদেষ্টার দ্রæুত হস্তক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানানো হয়।

চলমান পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন কর্তৃক নিম্নোক্ত আন্দোলন ঘোষণা করা হয়-১. পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি জাতীয় সমস্য। এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পাহাড় প্রায় সময় অশান্ত হয়ে উঠে।

খাগড়াছড়ি ও গুইমারাতে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তারই একটা জলন্ত দৃষ্টান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যার সমাধানের উপায় চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তাই পাহাড়ের সমস্যা জিইয়ে না রেখে চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দেশের সকল রাজনৈতিক পক্ষসমূহ ও সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনকে সাথে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে একটা জাতীয় সংলাপ জরুরি।

আশাকরি, অন্তর্র্বতী সরকার এই জাতীয় সংলাপ দ্রæুতই আয়োজন করবে। এছাড়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষ থেকেও একটি সংলাপের আয়োজন করা হবে।

২. খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের মেডিকেল রিপোর্ট কোন প্রক্রিয়ায় জনসম্মুখে চলে এলো, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। এই বিষয়ে খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদানের দাবি করছি। সেই সাথে ধর্ষিত কিশোরীর পিতা মেডিকেল রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করার বিষয়টিও আমরা জেনেছি।

আমরা এই বিষয়ে কিশোরীর পিতার বক্তব্য আমলে নিয়ে দ্রæুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবী জানাই এবং সেই সাথে নির্যাতিত কিশোরী এবং তাঁর পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবী উত্থাপন করছি।

৩. খাগড়াছড়ির সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনায় সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং মদদের অভিযোগের ঘটনাবলীর বস্তুুনিষ্ঠ তদন্তের জন্য নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি যুক্ত করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।

৪. নিহত ও আহতদের পরিবারকে সুরক্ষা, যথার্থ ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, সেই সাথে হত্যার শিকার হওয়া প্রতিটি পরিবারকে কমপক্ষে ৫০লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের সামরিকীকরণ নীতি পরিহার করে সিভিল প্রশাসনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ, রাজনৈতিক সমাধানের পথে এগোতে হবে।

৬. পাহাড়ের ঘটনাবলী সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এবং স্থানীয় ভুক্তভোগীদের আন্দোলন সংগ্রাম যাতে দমন করা না হয়, সেজন্য অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
৭. সর্বোপরি সময়সূচীভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দ্রæুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করে পার্বত্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।

গত ২৭ ও ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২৫ সদর উপজেলা ও গুইমারায় সংঘটিত জুম্মদের উপর সেটেলার বাঙালি ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(পিসিজেএসএস)।

২৭ ও ২৮শে সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারের তরফ থেকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা প্রদান করা, খাগড়াছড়ি-গুইমারায় সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ব্যক্তিদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা-উক্ত সুপারিশমালা ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, খাগড়াছড়ি সদরস্থ সিঙ্গিনালা এলাকায় ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক জুম্ম কিশোরীকে তিনজন সেটেলার বাঙালি কতৃর্ক গণধর্ষণের ঘটনায় গত ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০২৫ ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র সাথে সেটেলার বাঙালিদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ফলে অন্তত ৩তিন জুম্ম গুরুতর আহত এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা রামসু বাজার ও এর আশেপাশের জুম্ম বসতিতে সেনাবাহিনী, বাঙালি সেটেলার ও বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীদের কতৃর্ক সম্মিলিভাবে উপযুর্পরি হামলায় ৩জন জুম্ম নিহত এবং অন্তত ৩০জনের অধিক আহত হয়েছে।

এছাড়া রামসু বাজারে জুম্মদের ৫৪টি দোকান, ২৬টি ঘরবাড়ি ও ১৬টি মোটরসাইকেল অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়। এতে জুম্মদের প্রায় ২৫কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চলমান ২০২৫সনের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর মাসে সেটেলার বাঙালি, বহিরাগত বাঙালি শ্রমিক ও ব্যক্তি কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা, উত্যক্তকরণ ইত্যাদি ২১টি সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে এই পর্যন্ত ২৯জন জুম্ম নারী ও শিশু মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন।

দশকের পর দশক ধরে চলা এইসব সহিংসতার ঘটনার শিকার নারী ও শিশুর সংখ্যা অগণিত হলেও পাহাড়ের মানুষ এই সব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার আজও পেয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। এই যাবত কালে সংঘটিত নারী সহিংসতার ঘটনা বিশেষত ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণের মতন বর্বর পৈশাচিক ঘটনাবলীর বিচার তো দূরে থাক সঠিক তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি।

খাগড়াছড়ি সাম্প্রদায়িক ঘটনায় সরকার ইউপিডিএফের উস্কানি রয়েছে মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২৫ উক্ত গণধর্ষণের প্রতিবাদ ও পাহাড়ে সকল নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ি সদরস্থ ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ ব্যানারে এক মহাসমাবেশ আয়োজন করা হয়। কিন্তু উক্ত সমাবেশে ইউপিডিএফের কতিপয় লোক সমাবেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে শুরু হতে নানাভাবে সমাবেশটিতে বিশৃংঙ্খলা ও বিভিন্ন উস্কানি প্রদান করে।

অনুরূপভাবে গুইমারা ঘটনায়ও ইউপিডিএফের উস্কানীতে সহিংস রূপ ধারণ করেছে বলে দোষারোপ করা হয়। তবে ইউপিডিএফ সম্পুর্ন ভাবে অম্বীকার সহিংসতা ক্ষতিগ্রস্তদের সেটেলার কর্তৃক হামলা প্রতিবাদ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করেছেন।

সেখানে আরো বলা হয়, খাগড়াছড়ির এক জুম্ম নারীকে গণধর্ষণের প্রতিবাদে বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিল(বিএমএসসি), খাগড়াছড়ি জেলার সাধারণ সম্পাদক উক্যনু মারমা প্রারম্ভে আন্দোলনের নেতৃত্ব পরিচালনা করেন ঠিকই কিন্তু পরবতীর্তে ২৭ ও ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২৫অবরোধ কর্মসূচিগুলোতে বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিল(বিএমএসসি) সাংগঠনিকভাবে সংযুক্ত নয় বলে একটি বিবৃতি প্রদান করে।

ফলে এই থেকে বোঝা যায, সেটেলার বাঙালি কতৃর্ক জুম্ম নারীকে গণধর্ষণের প্রতিবাদের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা জন্য প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ কতৃর্ক ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনকে নানাভাবে উস্কানি দিয়েছিল।

এছাড়া দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী ইউপিডিএফ-এর সমর্থক, পরামর্শক ও সহযোগী হিসেবে পরিচিত দুয়েকজন বøগার ও ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমেও বিভিন্ন বিভেদমূলক, উস্কানিমূলক ও হঠকারী বক্তব্য দিতে দেখা যায় বলে উল্লেখ করা হয়।

পিসিজেএসএস প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ১৯৯৭সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিশেষ মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় এই পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্তত: ২২টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে।

এ ধরনের সাম্প্রদাযিক হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা এবং সে লক্ষ্যে জুম্মদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, জুম্মদের ভূমি জবরদখল করা, তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করা, জুম্ম নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, সর্বোপরি জুম্মদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করা।

বস্তুুত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত ১৯৯৭সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের পথ নিহিত রয়েছে বলে উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

গুইমারা উপজেলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনের যেমন কঠোর অবস্থান, ঠিক তেমনি সেনাবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনমনে আতঙ্ক বৃদ্ধি বেড়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রান দিতে আসা সাধারন মানুষের চেকিং, তল্লাশিতে হয়রানি মূলক চরম অমানবিক ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

উল্লেখ্য, গত পরশু ২৮শে সেপ্টেম্বর সিঙ্গিনালায় কিশোরী ধর্ষণের বিচারের দাবিতে আহূত শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচীতে সেনা ও সেটলাররা গুইমারায় পরিকল্পিতভাবে নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রামেসু বাজারে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এতে থোয়াইচিং মারমা(২৫), আখ্রক মারমা(২৪) ও আথুইপ্রæু মারমা(২৬) তিন জন ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। অর্ধ শতাধিককে গুরুতর জখম হয়, অনেকে নিখোঁজ অবস্থায় রয়েছে।

নিহত তিন জনের মরদেহ খাগড়াছড়িতে ময়না তদন্তের নামে ইচ্ছেকৃতভাবে হাসপাতালে ফেলে রাখা হয়। পরে রাতের অন্ধকারে(রাত ১২টার দিকে) সেনা ও পুলিশ কড়া প্রহরায় গুইমারায় পাঠিয়ে তড়িঘড়ি করে আত্মীয়স্বজনের অনুপস্থিতিতে ধর্মীয় প্রথা অনুসরণ না করে দাহ করতে বাধ্য করা হয়। এতে জনমনে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।