খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ পাহাড় নিন্দা অব্যাহত বিভিন্ন সংগঠন

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় গুইমারা হামলার প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ পাহাড় নিন্দা অব্যাহত বিভিন্ন সংগঠন। গুইমারায় মারমা অধ্যুষিত সহিংসতা রামসু বাজারে ভয়াবহ সেনা-সেটলার হামলার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় বইয়ে যাচ্ছে। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর অনাকাংখিত এই হামলা হয়।

সেনাবাহিনী বিবৃতি দিয়ে এই হামলার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করলেও তা কেউ বিশ্বাস করেনি। মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা স্পষ্টভাবে বলেছেন, সেনাবাহিনীই সেদিন নির্বিচারে গুলি করেছে। তারা আইএসপিআরের বিবৃতিকে একপাক্ষিক বলে অভিহিত করেন।

দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে এই বর্বর হামলার বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, জেনেভা ও ফ্রন্সে বিক্ষোভ হয়ে গেছে। জাতিসংঘেও এই হামলা তুলে ধরা হয়েছে। আরও অন্যান্য দেশেও প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।

হামলার পর পরই ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম। অনেক এলাকায় মানুষ তৎক্ষণাৎ ত্রাণ সংগ্রহে নেমে পড়ে। প্রত্যেকে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। হাতে টাকা না থাকলে চাল দিয়েছে। দ্ইু বেলার খাবার থাকলে, সেখান থেকে এক বেলার খাবারের টাকা দিয়েছে।

প্রবারনা পুর্নিমা সীমিত পরিসরে রেখে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে। এক কথায়, প্রত্যেকে ক্ষতিগ্রস্তদেরকে একান্ত আপনজন মনে করে তাদের দুর্দিনে পাশে দাঁড়াতে চেয়েছে। ইউপিডিএফও জনগণের সাথে এক হয়ে রামসু বাজারের ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থেকেছে।

রামসু বাজারের হামলার পর যেভাবে পাহাড়ের জনগণ ঐক্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতা দেখিয়েছেন তা একটি বিরল দৃষ্টান্ত এবং অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ঘটনা। জনগণের এই ঐক্য দেখে সেনা-শাসকগোষ্ঠীর চিত্তে মহাভয় উদয় হয়েছে। তারা সবচেয়ে যেটা ভয় পায় তা হলো জনগণের মধ্যে ঐক্য। সেজন্য তারা জুম্ম জনগণের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির জন্য সকল ধরনের কূট কৌশল প্রয়োগ করে যাচ্ছে।

পার্বত্য ভিক্ষ সংঘ বাংলাদেশ গত ৫ই অক্টোবর, বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদ ৬ই অক্টোবর, মারমা উন্নয়ন সংসদ ৭ই অক্টোবর গুইমারায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে। ছবিটি পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ-এর ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহিত।

গুইমারার খুনীরা জানে, তারা কত বড় অন্যায়, কত বড় জঘন্য অপরাধ করেছে। কিন্তু তারা তাদের এই জঘন্য অপরাধ শত চেষ্টা করেও ঢেকে রাখতে পারবে না। খাগড়াছড়ি ও গুইমারার দুই জেনারেল তাদের কুৎসিত ও বীভৎস রূপ ঢাকতে যতই “অস্ত্র উদ্ধার” নাটক মঞ্চস্থ করুক, তাতে কোন ফায়দা হবে না।

গোটা বিশ্ববাসী জানে তাদের অপরাধ। যেভাবেই হোক মানবতার বিরুদ্ধে এই অপরাধের শাস্তি তাদেরকে একদিন পেতেই হবে। বর্তমানে তারা ক্ষমতার দম্ভে মদমত্ত হলেও, এটাই হলো বিশ্বপ্রকৃতির অমোঘ নিয়ম।

আজ ক্ষমতার জোরে দিনকে রাত বানিয়ে গুইমারা হামলা ও গণহত্যার জন্য মিথ্যাভাবে ইউপিডিএফ-এর ওপর দায় চাপানো হচ্ছে। সেনাবাহিনী, তাদের বশংবদ মিডিয়া গোষ্ঠী ও তাদের পদলেহী দালালরা দিনরাত অফুরন্ত বাক্য বিস্তার করে অপরাধীদের রক্ষা করতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ভূমিকা হলো পাহাড়ি দালালদের।

তাদের কথার অর্থ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো: যারা ধর্ষণের বিচার চেয়েছে, যারা শান্তিপূর্ণ অবরোধ করেছে, তারাই যেন দোষী। জুম্ম ছাত্র জনতা অবরোধ না দিলে সেনা সেটলাররা হামলা করতো না। এটা যেন ধর্ষিতা সম্পর্কে একশ্রেণীর মৌলবাদীদের বয়ানের মতো: ধর্ষিতা যদি ‘সে ধরনের’ পোশাক না পরতো, তাহলে হয়ত ধর্ষণের শিকার হতো না। ধর্ষিতাই ধর্ষককে আহ্বান করেছে। এখানে পোশাক পরার স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে তারা আড়াল করে, পোশাক পরাই যেন দোষ।

এইভাবে দালালরা মৌলবাদীদের মতো কূটযুক্তি দিয়ে গণহত্যাকারী সেটলারদের অপরাধ আড়াল কিংবা লঘু করে দিতে চাইছে। এই জাতিদ্রোহী দালালদের বুঝার ক্ষমতা নেই যে, বিচার চাওয়া, শান্তিপূর্ণ অবরোধ করা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ।

তবে আশার কথা হলো, যেসব দালাল হামলাকারী সেনাবাহিনী ও সেটলারদের পক্ষে সাফাই গাইছে, তারা জনগণের কাছে ঘৃনা ও নিন্দার পাত্র হয়ে উঠেছে। থোয়াইচিং, আখ্রক ও আথুইপ্রæুর রক্ত বৃথা যাবে না। তারা বীর শহীদ। জুম্ম জাতি তাদের রক্তের ঋণে চিরদিন ঋণী হয়ে থাকবে।

গুইমারা উপজেলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনের যেমন কঠোর অবস্থান, ঠিক তেমনি সেনাবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনমনে আতঙ্ক বৃদ্ধি বেড়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রান দিতে আসা সাধারন মানুষের চেকিং, তল্লাশিতে হয়রানি মূলক চরম অমানবিক ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

উল্লেখ্য, গত পরশু ২৮শে সেপ্টেম্বর সিঙ্গিনালায় কিশোরী ধর্ষণের বিচারের দাবিতে আহূত শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচীতে সেনা ও সেটলাররা গুইমারায় পরিকল্পিতভাবে নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রামেসু বাজারে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এতে থোয়াইচিং মারমা(২৫), আখ্রক মারমা(২৪) ও আথুইপ্রæু মারমা(২৬) তিন জন ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। অর্ধ শতাধিককে গুরুতর জখম হয়, অনেকে নিখোঁজ অবস্থায় রয়েছে।

নিহত তিন জনের মরদেহ খাগড়াছড়িতে ময়না তদন্তের নামে ইচ্ছেকৃতভাবে হাসপাতালে ফেলে রাখা হয়। পরে রাতের অন্ধকারে (রাত ১২টার দিকে) সেনা ও পুলিশ কড়া প্রহরায় গুইমারায় পাঠিয়ে তড়িঘড়ি করে আত্মীয়স্বজনের অনুপস্থিতিতে ধর্মীয় প্রথা অনুসরণ না করে দাহ করতে বাধ্য করা হয়। এতে জনমনে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।