অবরোধ স্থগিতের ঘোষণা
খাগড়াছড়ির ওই কিশোরীর মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত মেলেনি

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা সদরের সিঙ্গিনালা এলাকার অষ্টম শ্রেণির মারমা কিশোরীর মেডিকেল রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। মেডিকেল টেস্টে গণধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের কোনো আলামত পাননি চিকিৎসকরা। খাগড়াছড়ি জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালের ৩জন চিকিৎসকের ২৮শে সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত মেডিকেল রিপোর্টে এ তথ্য পাওয়া যায়।
২৩শে সেপ্টেম্বর রাতে ১২বছর বয়সী ওই কিশোরী খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়।
কিশোরীর বাবার অভিযোগ, ওই দিন(২৩শে সেপ্টেম্বর) স্থানীয় এক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট শেষে বাড়ি ফেরার পথে রাত সাড়ে ৯টার দিকে নিখোঁজ হয় তার কিশোরী কন্যা। রাত সাড়ে ১১টার দিকে স্থানীয়রা খোঁজাখুঁজি করে স্থানীয় শাসন রক্ষিত বৌদ্ধ বিহারের পাশে পানিযুক্ত জমিতে খুঁজে পায় এবং সেখান থেকে তাকে খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
গণধর্ষণের অভিযোগ এনে কিশোরীর বাবা ওই দিন রাতেই খাগড়াছড়ি সদর থানায় এজাহার দায়ের করেন। তাঁর অভিযোগ তার মেয়েকে অজ্ঞাত ৩যুবক পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। তিনি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে সদর থানায় এ এজাহার দায়ের করেন।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে পরের দিন বুধবার বেলা ১১টার সদরের সিঙ্গিনালা এলাকার ১নং ওয়ার্ড থেকে শয়ন শীল(১৯) নামে সন্দেহভাজন এক কিশোরকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় আটক করা হয়। আদালতের নির্দেশে আটক কিশোরকে ৬দিনের রিমান্ডে আনে পুলিশ।
অষ্টম শ্রেণির স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ কেন্দ্র করে ইউপিডিএফের ইন্ধন অভিযোগে ২৪শে সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সহিংস সড়ক অবরোধ কর্মসূচি চালায় জুম্ম ছাত্র জনতা। এতে সংহতি জানায় ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম নামে ৩টি সংগঠন। তারা ওই দিন বেলা ১০টার দিকে মাটিরাঙার বাইল্যাছড়িতে আঞ্চলিক মহাসড়কের উপর গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে।
সেখানে একটি মোটর সাইকেলে আগুন দেয়। পিকেটিংয়ের সময় কান্টা, গুলতি ও অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করে। আধা বেলা সড়ক অবরোধের সময় শেষ হবার পরও বিক্ষোভকারীরা সড়কে অবস্থান করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। বিজিবি সদস্যদের বহনকারী একটি গাড়ি আটকে দেয়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেও সাড়া দেয়নি অবরোধ সমর্থকরা। উল্টো নানাভাবে বিজিবি, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের নাজেহাল করার চেষ্টা করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ২৫শে সেপ্টেম্বর আধা বেলা হরতাল এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর সহিংস অবরোধ কর্মসূচির নামে সড়কে নাশকতা চালানো হয়। ২৬শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের সাথে কোনো কিছুতে জড়ায় নি। তারা হঠাৎ করে সেনা দলের একটি পিকআপ আক্রমণ করে। যেখানে ৩জন সেনা সদস্য আহত হন।
সেনাবাহিনী মানবিকতার পরিচয় দিয়ে ধৈর্য্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। তাদের সাথে কোনো প্রকার বাক-বিতন্ডায় না গিয়ে কোনো প্রকার বল প্রয়োগ ছাড়াই চলে যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা পুরো খাগড়াছড়িতে সমাবেশ ডেকে পুরো ঘটনাটিকে অন্যদিকে প্রবাহিত করে। তারা খাগড়াছড়িতে ২৭শে সেপ্টেম্বর অবরোধ ডাকে এবং অ্যাম্বুলেন্স ভাঙ্চুর করে।
সাধারণ জনগণের উপর চড়াও হয়। তারা ধর্ষণ ইস্যু সামনে এনে সড়কে নাশকতা ও সহিংতা শুরু করলে জান-মাল রক্ষায় ২৭শে সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুর ২টা থেকে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ও খাগড়াছড়ি পৌরসভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ধারা জারি করে জেলা প্রশাসন। একই সঙ্গে গুইমারা উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ধারা জারি করে।
ইউপিডিএফ এবং তাদের অংগ সংগঠনগুলো খাগড়াছড়িতে সফল হতে না পেরে ২৮শে সেপ্টেম্বর গুইমারাতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে একইভাবে পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে সহিংসতায় ৩জন নিহত হয়। আহত হয় অনেক। এই টেকনিক ফলো করে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা চালায়। এতে বহিঃশক্তি ও পাহাড়ের একটা মহল তাদেরকে পেছন থেকে ইন্ধন দিচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়।
এদিকে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ সমর্থিত অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে জুম্ম ছাত্র-জনতা নামের সংগঠনটি। অষ্টম শ্রেণির মারমা কিশোরীর মেডিকেল রিপোর্ট নেগেটিভ আসার খবর প্রকাশের পরপরই অবরোধ স্থগিতের ঘোষণা দিল সংগঠনটি।
মঙ্গলবার(৩০শে সেপ্টেম্বর) রাত ৯টায় দেয়া ওই স্ট্যাটাসে উল্লেখ করা হয়, চলমান অবরোধ রাত ১১টা থেকে ৫ই অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। তবে দাবি গুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও প্রশাসনের কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যতে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গতকাল সোমবার(২৯শে সেপ্টেম্বর) আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত এক বৈঠকে জুম্ম ছাত্র-জনতার ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। যার ৬জনই ইউপিডিএফের কর্মী। সেখানে তারা ৮দফা দাবি তুলে ধরেন।
যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের অভিযোগ কেন্দ্র করে এত সহিংসতা, নাশকতা, প্রাণহানী সেই অষ্টম শ্রেণির মারমা কিশোরীর মেডিকেল রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। মেডিকেল রিপোর্ট কিংবা আইনি প্রক্রিয়ার অপেক্ষা না করেই অষ্টম শ্রেণির স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ কেন্দ্র করে ইউপিডিএফের ইন্ধনে সহিংস সড়ক অবরোধের ডাক দিয়ে জান-মালের ক্ষতি করতে শুরু করে ইউপিডিএফ সমর্থিত এই জুম্ম ছাত্র জনতা।
যার ফলে ১৪৪ধারা জারি করতে বাধ্য হয় জেলা প্রশাসন। ১৪৪ধারা জারি থাকার মধ্যেই ২৮শে সেপ্টেম্বর গুইমারার রামসু বাজার এলাকায় সহিংস সংঘর্ষ হয়, এতে ৩জন নিহত এবং আহত হন অনেকে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে গুইমারার সংঘর্ষ-ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা, জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার, পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল, রামগড় সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ওথোইন, গুইমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আইরিন আক্তার, বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্টাতা সভাপতি ¤্রাসাথোয়াই মারমা, মারমা উন্নয়ন সংসদ সদর সাধারন সম্পাদক নিয়ং মারমা, বাংলাদেশ মারমা ষ্টুডেন্ট কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি, গুইমারা উপজেলা সাবেক চেয়ারম্যান উশ্যৈপ্রæু মারমা, গুইমারা থানার ওসি এনামুল হক চৌধুরী, গুইমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মংশ্যি চৌধুরী, মেম্বার কংহ্লাপ্রæু মারমা।
ঘটনার তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকলে ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়া হবে।
ঘটনার বিবরনে জানা যায়, খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজার এলাকায় অবরোধ পালনকালে সেনাবাহিনী ও সেটলার বাঙালিরা অবরোধ পালনকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলি বর্ষণ এবং বাজারের দোকানপাট ও ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
সেনা-সেটলারদের সাথে সেনাসৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে ‘মোত্তালেব’ বাহিনীর সন্ত্রাসীরাও হামলায় যোগ দেয় এবং ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
হামলায় সেনা-সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৩জন ঘটনাস্থলে নিহত হন এবং ৩জন নারীসহ অন্তত ৩০জন আহত হন, যাদের অনেকের জখম গুরুতর বলে জানা গেছে। নিহত তিন জনের মধ্যে হলেন-১. থোয়াইচিং মারমা(২৫), পিতা- হ্লাচাই মারমা, গ্রাম-বটতলা পাড়া, হাফছড়ি, গুইমারা, তিনি পেশায় একজন ড্রাইভার; ২. আখ্রক মারমা(২৪), পিতা-আপ্রু মারমা, গ্রাম -সাইংগুলি পাড়া, বড়পিলাক, গুইমারা এবং ৩. আথুইপ্রু মারমা(২৬), পিতা-থোয়াইহ্লাঅং মারমা, গ্রাম লিচু বাগান, হাফছড়ি, গুইমারা।
আহতদের মধ্যে অনেকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, তাদের ৫জনকে সেখান থেকে চট্টগ্রামে রেফার করা হয়েছে। এছাড়া আহতদের অনেকে ভয়ে হাসপাতালে না গিয়ে এলাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। আহতদের তালিকায় একজন মানসিক প্রতিবন্ধী নারীও রয়েছেন। সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে সেটলাররা রামেসু বাজারটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এতে কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়। সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত মানসিক প্রতিবন্ধী নারী আনুমা মারমা(২১)।
ঘটনার সূত্রপাত:
গত ২৭শে সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলায় দিনব্যাপী অবরোধ পালনকালে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পরিষদ এলাকায় অবরোধকারী ছাত্র-জনতার ওপর সেটলাররা হামলা করলে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থতিতে প্রশাসন দুপুর ২টা থেকে খাগড়াছড়ি পৌরসভা ও উপজেলা জুড়ে ১৪৪ধারা জারি করে। কিন্তু এর মধ্যেও সেটলাররা মহাজন পাড়া ও পানখাইয়া পাড়ার য়ংড বৌদ্ধ বিহার এলাকায় পাহাড়িদের ওপর হামলা ও দোকানপাটে ভাঙচুর চালায়। তিন পাহাড়ি যুবককের কুপিয়ে জখম করে। এদিন গুইমারা উপজেলা প্রশাসনও ১৪৪ধারা জারি করে, যদিও সেখাানে কোন ঘটনা ঘটেনি।
খাগড়াছড়ি সদরে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে জুম্ম ছাত্র জনতা পূর্বের দাবি কিশোরী ধর্ষকদের গ্রেফতার-শাস্তির দাবিতে ও হামলার প্রতিবাদে ২৮শে সেপ্টেম্বর থেকে লাগতার সড়ক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
এরপর গতকাল(২৮শে সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে এলাকার ছাত্র জনতা গুইমারার রামেসু বাজার এলাকায় গুইমারা টাউন হলের সামনের সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছের গুড়ি ফেলে অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে। তারা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে অবরোধ পালন করলেও দুপুরের দিকে সেনাবাহিনীর একটি দল সেখানে গিয়ে অবরোধ পালনকারীদের সাথে কথা বলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে সেনাদেরকে অবরোধকারীদের বলতে শোনা যায়, ইতোমধ্যে একজন ধর্ষককে গ্রেফতার করে রিমাÐে নেওয়া হয়েছে। বাকী ধর্ষকদের ধরতে একটু সময় লাগবে। তারা তাদেরকে ১৪৪ ধারা জারির কথা জানিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে যেতে বলে। তখন ছাত্র জনতা ধর্ষকদের গ্রেফতার ও খাগড়াছড়ি সদরে হামলার বিষয়ে তাদেরকে বলেন এবং অবরোধ বহাল রাখেন। এ বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাদের মধ্যে বাগবিতÐা চলে।
এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এগিয়ে এসে ছাত্র জনতার মাঝে ঢুকে পড়ে লাঠিচার্জ শুরু করে। এতে ছাত্র জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। এমতাবস্থায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে পরে সেখাানে সেটলার ও সেনা সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে মোত্তালেব বাহিনীর একটি সশস্ত্র দল সেখানে এসে উপস্থিত হয়।
সাথে সাথে সেটলাররা রামেসু বাজারের দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দিতে থাকে এবং সেনাবাহিনী ও ঠ্যাঙাড়েরা ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে একে একে লোকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হতে থাকেন। এ সময় এক ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়। অনেকে যে যেদিকে পারে নিজেকে রক্ষা করতে সরে যেতে থাকে। অনেকে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
অপরদিকে সমানতালে রামেসু বাজারের দোকানপাটে আগুন দিতে থাকে সেটলাররা। একে এক পুড়ে যায় বাজারের সব দোকান ও বাজারের আশে-পাশে পাহাড়িদের বসতবাড়ি। এতে অন্তত ৫০টি দোকান ও ১৬টি বসতবাড়ি পুড়ে যায়।
এছাড়া সেটলাররা বাজারে রাখা পাহাড়িদের ১৬টি মোটর সাইকেল ও ১টি মাহেন্দ্র(থ্রি হুইলার) গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। অথচ সেটেলার বাংগালীদের পাশর্^বতী বসবাসকারী অক্ষত অবস্থায় ঘর-বাড়ি থাকলেও কোন ক্রমে ক্ষতি সাধিত হয়নি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ১৯সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সেটলাররা সেনাবাহিনীর সাথে থেকে “আল্লাহু আকবর, নারায়ে তাকবির” ধ্বনি দিচ্ছে আর সেনাবাহিনী ব্রাশ ফায়ার করছে। হামলার পর সেনারা সরে গেলে তাদের সৃষ্ঠ ঠ্যাঙাড়ে মোত্তালেব বাহিনীর সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র অবস্থায় রামেসু বাজারে অবস্থান নেয়। এতে নিহত-আহতদের উদ্ধার করতে বেগ পেতে হয়। পরে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনকে অবগত করা হলে বিকেলে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে এবং ৩জনের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
বর্তমান পরিস্থিতি:
গতকালের হামলার ঘটনার পর সেনাবাহিনীসহ আইনশঙ্খলা বাহিনী নানা তৎপরতা চালায়। তারা ড্রোন উড়িয়ে নজরদারি করে। রাতভর সেনারা রামেসু বাজার এলাকায় অবস্থান করে। সোমবার, মংগল ও বুধবার পর্যন্ত দিনভর তারা খাগড়াছড়ি সদর ও রামেসু বাজার এলাকায় অবস্থান করে ঘরে ঘরে অযথা হয়রানি মূলক অভিযান অব্যাহত রেখে নিরিহ সাধারন মানুষকে আটক করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপজেলার মোড়ে মোড়ে গাড়িযোগে টহল দিচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এদিকে, সোমবার বিকেল খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতাল থেকে ময়না তদন্ত শেষে নিহতদের মরদেহগুলো নিয়ে আসার কথা থাকলেও ময়না তদন্ত শেষ না হওয়ায় এখনো মরদেহ গুলো খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের মর্গে সেনাবাহিনী কড়া নিরাপত্তায় গুইমারা পরিবারে কাছে পৌছে দিয়ে তাড়াতড়ি করে রাতে-আধারে ১টায় বাধ্যভাবে দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চাপ প্রয়োগ করে।
প্রতিবাদ গুইমারা ও খাগড়াছড়ি সদরে অবরোধকারী ছাত্র জনতার ওপর হামলা, গুলি করে হত্যা, অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে গতকাল চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহীতে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করা হয়েছে। গত২৯শে সেপ্টেম্বর রাঙামাটির কাউখালীতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম যৌথভাবে বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন, ব্যক্তি এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেছে।
খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন ছাবের আহম্মেদ বলেন, গতকাল রোববার থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত আহত ১৪জনকে সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে ১৩জন চিকিৎসাধীন, ৫জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের লাশও হাসপাতাল থেকে কড়া সেনাবাহিনী পাহাড়ায় ময়না তদন্ত শেষে রাত ১টার দিকে গুইমারা পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সহিংসতার ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে, অবরোধ তুললেই ১৪৪ধারা প্রত্যাহার করবে প্রশাসন। জেলার গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজার এলাকায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িঘর ও দোকানপাট পরিদর্শন শেষে ত্রাণ বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক। খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজার এলাকায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িঘর ও দোকানপাট পরিদর্শন শেষে ত্রাণ বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক।
খাগড়াছড়িতে জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকা অবরোধ তুলে নিলেই ১৪৪ধারাও প্রত্যাহার করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল খন্দকার। একই সঙ্গে জেলার গুইমারার রামেসু বাজারে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। মঙ্গলবার(৩০শে সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ কথাগুলো বলেন।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল খন্দকার বলেন, ‘খাগড়াছড়ির চলমান পরিস্থিতি আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান করতে চাই। অবরোধ আহŸানকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। তাঁদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। জুম্ম ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে যে ৮টি দাবি দিয়েছে তার মধ্যে সাতটি অ্যাড্রেস করা হয়েছে।
সহিংসতার ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সদস্যদের নাম পরে জানানো হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ধারা প্রত্যাহার করতে চাই। তবে অবরোধ প্রত্যাহার করতে হবে। ১৪৪ধারা তুলে নেওয়ার সঙ্গে অবরোধের বিষয়টি সম্পর্কিত।’
পাহাড়ি এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকা সড়ক অবরোধ চলাকালে গত রোববার রণক্ষেত্র হয়ে উঠে গুইমারার রামেসু বাজার। বাজার এলাকার প্রায় অর্ধশত বসতবাড়ি ও ৪০টির মতো দোকান আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় গুলিতে নিহত হন ৩জন। তাঁরা সবাই পাহাড়ি মারমা জনগোষ্টি। আহত হন সেনাবাহিনীর মেজরসহ অন্তত ২০জন।
দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাতে ত্রাণ তুলে দেন জেলা প্রশাসক। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার কাজ করেছে বলেও জানান তিনি। জেলা প্রশাসক বলেন, আহত ব্যক্তিদের যাতে সুচিকিৎসা নিশ্চিত হয় তার জন্য প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পাশে থাকবে প্রশাসন। নিহত থোয়াইচিং মারমার পিতা হ্লাচেং মারমা বাড়িতে গিয়ে ধর্মীয় সৎ কাজের জন্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরার ১লক্ষ ও জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল খন্দকার ৫০হাজার টাকা করে প্রত্যক নিহত পরিবার কাছে অনুদান দেওয়া হয়।
অন্য দুই নিহত পরিবারের প্রতিটিকে জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ ৮০পরিবারের মাঝে ৩০কেজি করে চাল ও কাপড় বিতরণ করা হয়। এই ক্ষতি অপূরণীয় হলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আরো সহায়তা করা হবে বলে আশ^াস দেন।
ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান জেলা প্রশাসক। এ জন্য সময় প্রয়োজন বলে জানান তিনি। অনুষ্ঠানে জেলা পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, খাগড়াছড়িতে যে সহিংসতা, সংঘর্ষ এ ঘটনায় মামলা হবে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবার মামলায় অনাগ্রহী হলে পুলিশ মামলা করবে।
নারীদের জীবনে হাহাকার
একদিকে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছেন, আরেক দিকে জীবিকা আয়ের অবলম্বন দোকানও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে—এখন সর্বস্ব হারানো রামেসু বাজার এলাকার বাসিন্দারা পড়েছেন অক‚লপাথারে। আগুনের লেলিহান শিখা শুধু তাঁদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়নি, বেঁচে থাকার অবলম্বনও শেষ করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামীর দিনগুলো শুধুই অন্ধকার দেখছেন লা সা প্রু মারমার মতো এই বাজারের পাহাড়ি নারীরা।
ঘর-দোকান হারানোর শোকে ক্ষোভ জন্মেছে লা সা প্রু মারমার মনে। ক্ষুব্ধ এই পাহাড়ি নারী বলতে থাকেন, ‘সবাই শুধু আগুনের তালে থাকে। কিছু হলেই আগুন ধরিয়ে দেয়। আমাদের ঘরবাড়ি কেন পুড়িয়ে দেবে? কেন দোকান জ্বালিয়ে দেবে? তার চেয়ে আমাদের মেরে ফেলুক।’
হ্লাসাংপ্রæু মারমার দুই জা-শিনুচিং চৌধুরী ও হ্লাপাই মারমাও হারিয়েছেন সবকিছু। শিনুচিং চৌধুরী, স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষিকা। ঋণ নিয়ে বাজারে দোতলা ভবন করে দোকান দিয়েছিলেন তিনি। দোকানের আয় ও বেতনে চলত সংসার, সন্তানের পড়াশোনার খরচও। তাঁর বড় মেয়ে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছোট ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে ঢাকায় কোচিং করছে।
এখন শিনুচিংয়ের দোকানটির সঙ্গে ঘরও পুড়ে ছাই।
গত রোববারের দুপুর বেলা জীবনের বেদনাদায়ক মুহূর্ত হয়ে থাকবে শিনুচিং চৌধুরীর। দুঃসহ সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন এই নারী। চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। বলতে থাকেন, ‘ভয়ে প্রথমে বাথরুমে লুকিয়ে পড়েছিলাম। পরে বের হয়ে আসি। অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে কোনোরকম জান নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। কী ঘটেছে, কী হয়েছে, তার কিছুই আমরা জানি না; কিন্তু আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল। দোকানটাও পুড়িয়ে দিল।’
সামনের দিন নিয়ে শঙ্কার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই স্কুলশিক্ষিকা। তিনি বলেন, ‘ঋণ শোধ করব কীভাবে? সন্তানদের পড়াশোনার খরচ দেব কীভাবে? ঘর চালাব নাকি লোন শোধ করব?’ বসতবাড়ি হারানো শিনুচিং চৌধুরীর প্রশ্ন, ‘যখনই কোনো সমস্যা হয়, তখনই ঘর পুড়িয়ে দেয়। ঘরবাড়ি কেন পুড়িয়ে দেবে? ঘর কী দোষ করেছে?’
অন্য জা হ্লাপাই মারমার আয়ের উৎসও ছিল একটি কাপড়ের দোকান। সেই দোকান ও বসতঘর দুই-ই পুড়ে গেছে। এখন দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। দুই মেয়ের একজন পড়েন চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে(এইউডবিøউ)। ছোট মেয়ে এবার একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। কান্নাভেজা কণ্ঠে জা হ্লাপাই মারমা বলেন, ‘এক কাপড়েই ঘর ছেড়েছি। কিছুই বের করতে পারিনি। ঘরের সবকিছু পুড়ে ছাই।’
এই তিন পাহাড়ি নারীর দুশ্চিন্তা সব তো হারিয়েছেন, এখন নতুন করে কীভাবে ঘর করবেন। কীভাবে দোকান চালু করবেন তার কোনো দিশা পাচ্ছেন না। এসব করতে যে টাকার দরকার, তা তাঁদের নেই।
বড়দের মতো সহিংসতার আগুন কেড়ে নিয়েছে শিশু-কিশোরদের স্বপ্নও। হ্লাপাই মারমার ছোট মেয়ে ক্ল্যাচিংপ্রæু মারমা সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। নতুন বই কিনে পড়ার আনন্দটাও উপভোগ করতে পারেনি সে। তার বইগুলোও ভস্মীভূত হয়েছে আগুনে। চোখ ভরা জল নিয়ে বলল, ‘নতুন বইগুলো এখনো ভালো করে উল্টে দেখার সুযোগ পাইনি। তার আগেই ওরা আমার নতুন বইগুলো পুড়িয়ে দিল।’
বলার সময় কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে এই কিশোরীর। চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা। কান্নার আওয়াজ নেই। কিন্তু মায়ের দুঃখ, নতুন বইয়ের শোক, ভেঙেচুরে দিয়েছে ক্ল্যাচিংকে।
রোববারের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সে বলে, ‘সকাল থেকে মিছিল-মিটিং হচ্ছিল। আমাদের পাড়ার কেউ তো সেখানে ছিল না। তার পরেও আমাদের ঘরবাড়ি-দোকান সব জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। যখন আগুন দিচ্ছিল, তখন আমি, মা ও বাবা তিনজন তিন দিকে পালিয়ে যাই। কে কোন দিকে যাচ্ছি তার কিছুই জানতাম না। যাওয়ার আগে শুধু সার্টিফিকেটগুলো(সনদ) নিতে পারছি।’
ক্ল্যাচিংয়ের প্রশ্ন, ‘তারা(আগুন দেওয়া ব্যক্তিরা) আমাদের ঘর কেন জ্বালিয়ে দিল? জিনিসপত্র নিয়ে যেত। অন্তত রাতে তো ঘরে থাকতে পারতাম। এখন সে সুযোগটুকুও নেই।’
শিনুচিং চৌধুরী, হ্লাসাংপ্রæু মারমা, হ্লাপাই মারমা, ক্ল্যাচিং মারমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দিনের আলো প্রায় ফুরিয়ে আসছিল। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। আর কিছুক্ষণ পরে নামবে রাতের আঁধার। রামেসু বাজারের আগুন শুধু ঘরবাড়ি পোড়ায়নি, পুড়িয়ে দিয়েছে পাড়াবাসীর ভবিষ্যৎ, শিশুদের শিক্ষা, নারীদের আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন। এখন তাঁদের চোখে শুধু অশ্রæ, দুঃখ-ক্ষোভ আর অন্তরে ভয় আগামী দিনের অন্ধকার অনিশ্চয়তা।
নিহতদের লাশ গতকাল(শনিবার,২৮শে সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি সদর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও রোববার(২৯শে সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সেনাবাহিনী কড়া পাহাড়ায় ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। ঐদিন গভীর ১টায় তিনজনের লাশ সেনাবাহিনী কড়া পাহাড়ায় দাফন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
নিহতদের লাশ গতকাল সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে আসা পর সেনাবাহিনী কড়া চেকিংয়ের মধ্যে বিরক্তিকর অবস্থা রোগীরা চরম ভোগান্তি এবং লাশ গ্রহনকারী অভিভাবকরা আতংকে পড়তে হয়েছে। এর আগে গুইমারা লাশটি পৌছার সাথে সাথে ছাত্র-জনতা মিছিল কর্মসূচী থাকায় এই চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের দেবলছড়ি চেয়ারম্যান পাড়ার আথুই মারমা(২২), হাফছড়ি ইউনিয়নের সাংগুলি পাড়ার আখ্রক মারমা(২৫) ও রামসু বাজার বটতলার থোয়াইচিং মারমা(৩০)। রাতে ময়না তদন্তের পর লাশ গুলি গ্রহন করেন নিহত আথুই মারমার তার মামা চাইহ্লা মারমা, নিহত আখ্রক মারমার ”াচা রাপ্রæু মারমা, নিহত থোয়াইচিং মারমার পিতা হ্লাচেং মারমা। রাতে তারা সেনাবাহিনী কড়া নিরাপত্তায় গুইমারা উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হবে বলে পরিবার সূত্রে জানা যায়।
নিহত থোয়াইচিং মারমার পিতা হ্লাচেং মারমা জানান, তারা অনেক আতংকে আছে। ঘটনা দিন তার ছেলে ২টার দিকে গাড়ি ড্রাইভারকে ভাত দিতে গিয়ে হামলা রোসানলে পড়লে তাকে অমানবিক ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করেন। হত্যার বিচার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
তিনি অরো বলেন, এলাকায় উল্টো আক্রান্ত ক্ষতিগ্রস্তদের পুলিশ, সেনাবাহিনী ও র্যাবসহ যৌথবাহিনীরা ব্যাপক তল্যাশি করে ধর পাকড়, মামলা হয়রানি করার অভিযোগ করেছেন।
রামেসু বাজার পাড়ার বাসিন্দা সাহ্লাপ্রু মারমার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘কারা হামলা করেছে তা নতুন করে বলার কিছু নেই। পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। তাই বুঝে নেন পাহাড়িদের পাড়ায় কারা আগুন দিয়েছে। আগুনে অন্তত ৪০টি দোকান, ৫০টি বসতবাড়ি পুড়ে গেছে। কিছু গুদামও পুড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু পাহাড়িদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পুড়েছে তা নয়, এখানে থাকা বাঙালিদেরও ঘর পুড়েছে। আগুনে এসব ঘরের কিছুই নেই। সব পুড়ে গেছে। মোটর সাইকেল পুড়েছে ১৮টি। মানুষের ঘরবাড়িতে থাকা গরু–ছাগলও লুট করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সারাক্ষণ টেনশনে থাকতে হচ্ছে।’
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অংচিনু মারমা বলেন, তাঁর দুটি ঘর ও পাঁচটি দোকান পুড়ে গেছে। কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি। হামলার ভয়ে এক কাপড়ে পাড়া ছেড়ে চলে যান। এসে দেখেন ঘরবাড়ি দোকানপাট কিছুই আর নেই। এখন খোলা আকাশের নিচে আছেন। এত বড় ঘটনার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ খোঁজ খবর নেয়নি।
খাগড়াছড়ি এখনো থমথমে, চলছে অবরোধ
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, সোমবার সকাল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টহলে রয়েছে। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এদিকে জুম্ম ছাত্র-জনতার অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে জানানো হয়, দুপুর ১২টা থেকে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি ও ঢাকা-খাগড়াছড়ি সড়কে অবরোধ শিথিল করা হয়েছে। জানতে চাইলে জুম্ম ছাত্র-জনতার এক মুখপাত্র বলেন, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা এবং নিহত ব্যক্তিদের সৎকারের সুবিধার্থে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত দুই সড়কে অবরোধ শিথিল থাকবে।
গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে ওই কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে চয়ন শীল নামে একজনকে আটক করে পুলিশ। তাঁকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু পাড়ায় সেনাবাহিনী ও সেটলারদের হামলায় ৩ জন পাহাড়ি নিহত ও অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া সেটলারদের অগ্নিসংযোগের ফলে রামেসু বাজার ও আশেপাশের বেশ কিছু বসতবাড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
গতকাল রবিবার(২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২৫) দুপুরের দিকে জুম্ম ছাত্র জনতার আহŸানে শান্তিপূর্ণ অবরোধ পালনকালে বিনা উস্কানিতে এ হামলার ঘটনাটি ঘটে।
খাগড়াছড়ি পৌরসভার সিঙ্গিনালায় এক মারমা কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণে জড়িত সকলকে গ্রেফতার-শাস্তির দাবিতে এবং খাগড়াছড়ি সদরে সেটলার হামলার প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র জনতার আহŸানে তারা এই অবরোধ কর্মসূচি পালন করছিল।
উল্লেখ্য, গত ২৩শে সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের সিঙ্গিনালায় ৮ম শ্রেণির এক পাহাড়ি শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়া শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে তিন জন বাঙালি যুবক কর্তৃক সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। পরে এ ঘটনার প্রতিবাদ দেখা দিয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী শয়ন শীল(১৯) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে।
তবে অভিযুক্ত বাকী দু’জনকে গ্রেফতারে পুলিশকে কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। উক্ত ঘটনার প্রতিবাাদে ও সকল অপরাধীকে গ্রেফতারের দাবিতে ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’ নামের প্লাটফর্মের মাধ্যমে আন্দোলন চলছে। ধর্ষণ বিরোধী এ আন্দোলনে গুইমারায় উক্ত হামলা-হত্যাকাÐের ঘটনাটি ঘটেছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত ঘটেনি।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন