খাগড়াছড়ির বান্দরবানে খেয়াং নারীকে হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার-শাস্তির দাবিতে সমাবেশ

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বান্দরবানে খেয়াং নারীকে হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার-শাস্তির দাবিতে সদর খাগড়াছড়ি ও পানছড়িতে বিক্ষোভ নারী সমাবেশ করেছে। বান্দরবানের থানচিতে খেয়াং নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যাকারীদের গ্রেফতারপূর্বক সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে খাগড়াছড়িতে নারী সমাবেশ করেছে ইউপিডিএফভুক্ত তিন সংগঠন।
বৃহস্পতিবার (৮ মে) সকালে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ ও বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ যৌথভাবে এই সমাবেশের আয়োজন করে।
“সারাদেশে নারী নিপীড়ন, লাঞ্ছনা ও অবমাননার বিরুদ্ধে এক হও, রুখে দাঁড়াও” এই আহŸান সম্বলিত শ্লোগানে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা মাঠ থেকে মিছিল সহকারে চেঙ্গী স্কোয়ারে গিয়ে সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমার সভাপতিত্বে ও খাগড়াছড়ি জেলা শাখার আহŸায়ক এন্টি চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি মিঠুন চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক তৃষ্ণাঙ্কর চাকমা।
নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশের নারীরা কেউই নিরাপদে নেই। আমরা মনে করেছিলাম জুলাই অভ্যুত্থানের পরে গঠিত ইউনুস সরকারের সময়ে আমরা কিছুটা হলেও শান্তিতে থাকতে পারবো। আমরা পাহাড়ের মানুষ আশা করেছিলাম ইউনুস সরকারের সময়ে হয়তো সুবিচার পাবো, জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবো, আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
কিন্তু ইউনুস সরকারের ৮ মাসে আমরা দেখতে পাচ্ছি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশের নারী ও সাধারণ জনগণের কোন নিরাপত্তা নেই। সমতলে যেমন আছিয়ার মতো শিশুরা ধর্ষণ-হত্যার শিকার হচ্ছে, একইভাবে পাহাড়ে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হচ্ছে পাহাড়ি নারীরা।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারী ধর্ষণ নতুন কোন ঘটনা নয়।
অতীতে আমরা দেখেছি এই খাগড়াছড়িতে ৫ম শ্রেণির ছাত্রী কৃত্তিকা ত্রিপুরাকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা, বলপিয়ে আদামে ৯ জন সেটলার কর্তৃক প্রতিবন্ধী নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা। কিন্তু এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি।
নীতি চাকমা আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে পানিশমেন্ট জোন বানিয়ে সমতলে প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতি, অন্যায়-অপকর্ম করছে তাদেরকে এখানে বদলী করা হচ্ছে। আর এসব কর্মকর্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে নানা অপকর্ম সংঘটিত করছে। খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে আমরা সে ধরনের এক শিক্ষক দ্বারা ছাত্রী ধর্ষণ-নিপীড়ন হতে দেখেছি।
তিনি চিংমা খেয়াংকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা প্রশাসন তদন্ত করছে কিনা সে প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা দেখি সমতলে কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ধর্ষককে আটক করা হয়। কিন্তু চিংমা খেয়াংয়ের হত্যার ঘটনা চার দিন হয়ে গেলেও প্রশাসন এখনো কাউকে আটক করতে পারতে পারেনি। তাহলে কেন এমন বৈষম্য করা হবে?
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের সাথে বিমাতাসূলভ আচরণ করা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক যে ১১দফা নির্দেশনা জার রয়েছে তার কারণেই এখানে ধর্ষণ, নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। পাহাড়ি নারী ধর্ষণের মেডিকেল টেস্ট রিপোর্টের ওপর রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা থাকায় বরাবরই ধর্ষণের ঘটনায় নেটেটিভ রিপোর্ট দেওয়া হয়।
যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত যতগুলো ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার কোন বিচার আমরা পাইনি। তিনি অবিলম্বে চিংমা খেয়াং-এর হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার ও যথাযথ বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সাজা প্রদানের দাবি জানান।
মিঠুন চাকমা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে এখনো ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের মতই চলছে। দেশে খুন, গুম, অপহরণ, ছিনতাই, নারী ও শিশু ধর্ষণ-হত্যার ঘটনা আগের চেয়েও বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আরো বলেন, বান্দরবানে চিংমা খিয়াংকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা নতুন নয়।
এর আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের অহরহ ঘটনা ঘটেছে। বিলাইছড়িতে সেনা সদস্য কর্তৃক দুই মারমা কিশোরীকে ধর্ষণ-নির্যাতনসহ পাহাড়ে এ যাবত যত ধর্ষণ-হত্যার ঘটনা ঘটেছে কোন ঘটনারই সুষ্ঠু বিচার হয়নি, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হয়নি।
তৃষ্ণাঙ্কর চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারী-শিশুরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রশাসন এই ধর্ষণে মদদ দেয়ার কারণে এবং বিচার না হওয়ায় ধর্ষকরা বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস পেয়ে থাকে। অন্তবরতীকালীন সরকার নারীসহ সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ মন্তব্য করে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে যেভাবে নারী ধর্ষণ, খুন ও নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে তার জন্য ইউনুস সরকারের লজ্জা পাওয়া উচিত।
তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বান্দরবানে খেয়াং নারীকে ধর্ষণ-হত্যায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।
এদিকে “পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত কর” শ্লোগানে বান্দরবানে থানচিতে খেয়াং নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যাকারীদের গ্রেফতারপুর্বক সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম।
বৃহস্পতিবার(৮ই মে ২০২৫) সকাল ১১টায় পানছড়ির মনিপুর বিহার গেট থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বড়কলক ঘুরে আবারও মুনিপুর এলাকায় মিলিত হয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
মিছিল পরবর্তী সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারীসংঘের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক মানিকপুদি চাকমার সভাপতিত্বে ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের পানছড়ি উপজেলার সাধারণ সম্পাদক পরান্টু চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বরুন চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের পানছড়ি উপজেলা সভাপতি সুনীলময় চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা সহ-সাধারণ সম্পাদক পিংকু চাকমা।
সমাবেশে মানিকপুদি চাকমা বলেন।
আমরা নারীরা ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। বান্দরবানের থানচিতে খেয়াং নারীকে যেভাবে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে এটা কোন সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না। এধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা যদি প্রতিবাদ না করি তাহলে বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেমন কোন ধর্ষণের বিচার পাইনি, এইকভাবে বর্তমান ইউনুস সরকারের আমলেও কোন বিচার পাচ্ছি না। তিনি অবিলম্বে খেয়াং নারীকে হত্যার সাথে জড়িত অপরাধীদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
বরুন চাকমা বলেন, বাংলাদেশে সমতলে এক শাসন আর পার্বত্য চট্টগ্রামে আরেক শাসন চলছে। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন পাহাড়ি নারী ধর্ষণ হলেও নেটেটিভাবে মেডিকেল টেস্ট রিপোর্ট দেয়া হয়। আর এতে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। দেশের অন্য এলাকায় ধর্ষণের বিচার হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারী ধর্ষণের কোন বিচার হয় না।
এই বিচারহীনতার কারণে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ছাত্রনেতা সুনীল ময় চাকমা বলেন, আমরা পাহাড়িরা যুগ যুগ ধরে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছি। দেশের যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা একই দমননীতি জারি রাখে। ফলে এখানে ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনায় কোন সুষ্ঠু বিচার হয় না। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী নামধারী রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা অনেক পাহাড়ি নারী ধর্ষণ-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
এ এসব ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার কিংবা বিচারের আওতায় আনা হয়নি। ফলে দিন দিন ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি ধর্ষণসহ সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে খেয়াং নারী হত্যাকারীদের আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার দাবি করেন।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন