খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি বর্মাছড়িতে সেনা ক্যাম্প স্থাপন বিষয়ে আইএসপিআর-এর বিবৃতি মিথ্যা

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার লক্ষাছড়ি উপজেলাধীন বর্মাছড়িতে সেনা ক্যাম্প স্থাপন বিষয়ে আইএসপিআর-এর বিবৃতি মিথ্যা ও বিকৃত বয়ান মাত্র বলে ইউপিডিএফ মনে করেন। পরস্পর একইভাবে বর্মাছড়িতে সেনা ক্যাম্প স্থাপনে ইউপিডিএফ’র বাধার অভিযোগ সেটেলার বাংগালী অধিকারের সংগঠন পিসিএনপি’র।

বর্মাছড়িতে একটি সেনা ক্যাম্প স্থাপনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় জনগণের সাথে সেনাবাহিনীর সৃষ্ট বিরোধ সম্পর্কে আইএসপিআর-এর গতকাল সোমবার (২৭শে অক্টোবর ২০২৫) দেয়া বিবৃতিকে “মিথ্যা ও বিকৃত বয়ান” বলে অভিহিত করেছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)।

মঙ্গলবার (২৮শে অক্টোবর ২০২৫), ইউপিডিএফের মুখপাত্র অংগ্য মারমা সংবাদ মাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে উক্ত মন্তব্য করেন।

আইএসপিআরের মতো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এভাবে আগাগোড়া মিথ্যা তথ্যে পরিপূর্ণ একটি বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে বলে অংগ্য মারমা মনে করেন এবং বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত কতিপয় সেনা কমান্ডারের জঘন্য অপরাধ ও ব্যর্থতা ঢাকতে আইএসপিআর ইউপিডিএফ-কে বলির পাঁঠা বানাতে চাইছে।’

বর্মাছড়ির ঘটনা বিষয়ে অংগ্য মারমা বলেন, ‘বিনা অনুমতিতে জোর জবরদস্তি করে বিহার ও গ্রামবাসীর জমিতে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করতে চাইলে সেনাবাহিনীর সাথে এলাকাবাসীর বিরোধ তৈরি হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। তার ওপর জনগণের নিত্য চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে সেনাবাহিনী এলাকাবাসীর ক্ষোভকে আরও গভীর করে তোলে।

এ অবস্থায় বোধগম্য কারণেই আর্য কল্যাণ বনবিহার কর্তৃপক্ষ ও বর্মাছড়ি এলাকার জনগণ নিজেদের জমি ও অধিকার রক্ষার জন্য শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছেন এবং স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সুবিচারের দাবি জানিয়েছেন।’

অংগ্য মারমা বলেন, ‘ইউপিডিএফ জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী একটি দল এবং গত ২৭শে বছর ধরে গণতান্ত্রিকভাবেই ইউপিডিএফ অধিকার আদায়ের আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে। সুতরাং বর্মাছড়িতে পার্টি “দীর্ঘ সময় ধরে সশস্ত্র দলের ক্যাম্প তুলেছে” এবং বর্মাছড়িকে “অস্ত্র চোরাচালানের রুট” হিসেবে ব্যবহার করছে বলে আইএসপিআর যে দাবি করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও অসৎউদ্দেশ্য প্রণোদিত।’

ইউপিডিএফে ‘অর্কিড চাকমা’ নামে কোন নেতা বা সদস্য নেই জানিয়ে অংগ্য মারমা বলেন, ‘ইউপিডিএফ নেতা প্রসিত বিকাশ খীসা “আর্য কল্যাণ (বন)বিহারে নাশকতার উদ্দেশ্যে বড় আকারে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োাজন করার নির্দেশ” দেন বলে আইএসপিআর বিবৃতিতে যে দাবি করেছে, তা কল্পনাপ্রসূত ও জনগণের ধর্মীয় চেতনার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের সামিল।

প্রকৃত সত্য হলো, বিহার পরিচালনা কমিটি ও স্থানীয় উপাসক-উপাসিকারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে উক্ত ধর্মীয় সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এবং এর সাথে ইউপিডিএফ নেতার কোন সম্পর্ক নেই।’

ইউপিডিএফের শীর্ষ নেতারা “দেশের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি, বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক শক্তির পরিকল্পনায় ও আর্থিক সহায়তায় ‘মৃতদেহের রাজনীতি’(ঢ়ড়ষরঃরপং ড়ভ নড়ফু নধমং) এবং ঘৃনার রাজনীতিকে(ঐধঃব ঢ়ড়ষরঃরপং) পুঁজি করে পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করে তোলার” চেষ্টা করছে বলে আইএসপিআরের অভিযোগকে সম্পূর্ণ মনগড়া, ভিত্তিহীন ও দুরভিসন্ধিমূলক বলে প্রত্যাখ্যান করেন ইউপিডিএফ নেতা অংগ্য মারমা।

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মিথ্যা প্রচারণা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমনের নিত্য-ব্যবহৃত সেনা-হাতিয়ার, যা দশকের পর দশক ধরে পাহাড়ে প্রয়োগ করে জনজীবনকে অসহনীয় করে তোলা হয়েছে।’

গুইমারায় রামেসু বাজারে নির্বিচার গুলি চালিয়ে তিন মারমা যুবককে খুন করার পর আইএসপিআর এখন অপরাধী সেনা কমান্ডারদের রক্ষা করতে গোয়েন্ডা বলসীয় কায়দায় অপপ্রচার চালিয়ে সত্যকে “হত্যা” করার প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে চলেছে এবং অত্যন্ত হাস্যকরভাবে তাদের খুনের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অংগ্য মারমা মন্তব্য করেন।

ইউপিডিএফ-ই পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনা কমান্ডারদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার বলে দাবি করে ইউপিডিএফ নেতা বলেন, ‘ইউপিডিএফ-কে দমনের জন্য পিসিজেএসএস সন্তু গ্রুপসহ অন্যান্য ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও এসব ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর হাতে গত ২৭বছরে ইউপিডিএফের প্রায় ৪০০(চার শত) নেতা-কর্মী ও সমর্থক প্রাণ হারিয়েছেন।’

দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীর কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় দেখিয়ে দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জিগির তুলে সেনাবাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তা এই পাহাড়ি অঞ্চলে অব্যাহত সেনা উপস্থিতি নিশ্চিত করে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ হাসিল করার প্রয়াস চালাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন এবং এ সম্পর্কে সরকার ও দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।

অংগ্য মারমা জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিয়ে বর্মাছড়িতে ক্যাম্প নির্মাণ না করার উর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে সঠিক ও বাস্তব সম্মত বলে সাধুবাদ জানান এবং একইভাবে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অঘোষিত সেনাশাসন তুলে নেয়ার গণদাবিও পূরণ করার আহ্বান জানান।

একইভাবে খাগড়াছড়ির ল²ীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনে ইউপিডিএফের বাধা এবং সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, গুম ও খুনের ঘটনাবলীর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেছে সেটেলার বাংগালী সমর্থিত সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ(পিসিএনপি)।

মঙ্গলবার(২৮শে অক্টোবর) সকালে খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাব সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো: আলমগীর কবির। এতে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা অভিযোগ করেন, বর্মাছড়িতে সেনা ক্যাম্প স্থাপনকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফ সশস্ত্র সদস্যরা এলাকাবাসীর নিরাপত্তা বিঘিœত করার চেষ্টা করছে। তারা ধর্মীয় উসকানি সৃষ্টি করে জায়গাটি বৌদ্ধ মন্দিরের দাবি করলেও তদন্তে পাওয়া গেছে, সংশ্লিষ্ট জমিটি কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত নয়।

বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সা¤প্রতিক সময়ে হত্যা, ধর্ষণ, গুম, অগ্নিসংযোগসহ নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক স¤্প্রীতি নষ্ট করার অপচেষ্টা চলছে। এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দমনে প্রশাসনকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান তারা।

একই সঙ্গে পাহাড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজি কার্যক্রম বন্ধ করতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বক্তারা পাহাড়ি-সমতলের সকল জনগোষ্ঠীকে শান্তি, স¤্প্রীতি ও উন্নয়ন বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।

এর আগে লক্ষীছড়ি উপজেলায় বর্মাছড়িতে এলাকাবাসীর আপত্তি সত্তে¡ও আর্য কল্যাণ বনবিহার ও পাহাড়িদের মালিকানাধীন জমি বেদখল করে সেনা ক্যাম্প স্থাপন প্রচেষ্টার প্রতিবাদ জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনরত চার গণতান্ত্রিক সংগঠন।

গত শনিবার (২৫শে অক্টোবর ২০২৫) সংবাদ মাধ্যমে দেয়া এক যুক্ত বিবৃতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি জিকো ত্রিপুরা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অমল ত্রিপুরা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা উক্ত প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে বর্মাছড়ি থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানান।

উল্লেখ্য, গত কয়েকদিন আগে খিরাম আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল বর্মাছড়ি বাজার এলাকায় এসে আর্য কল্যাণ বনবিহারের জায়গায় কয়েকটি তাঁবু খাটায় এবং একটি স্থানে হেলিপ্যাডের চিহ্ন দিয়ে রাখে, যা সরকারে অহেতুক কোটি টাকার খরচে অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।

গত ২২শে অক্টোবর সকাল থেকে তারা সেখানে ক্যাম্প নির্মাণের জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করে। শুক্রবার(২৪শে অক্টোবর) সকালে সেখানে আরো অন্তত ১৮০জন সেনা সদস্য উপস্থিত হয় এবং ড্রোন উড়িয়ে এলাকায় নজরদারি করে। এমন পরিস্থিতিতে এলাকার বিক্ষুব্ধ জনগণ সেখানে ক্যাম্প স্থাপনের প্রতিবাদে ও মোতায়েনকৃত সেনাদের প্রত্যাহারের দাবিতে এই গণবিক্ষোভের আয়োজন করে।

গত শুক্রবার(২৪শে অক্টোবর) সকালে বর্মাছড়ি বাজার এলাকায় সেনারা ড্রোন উড়িয়ে সাধারন গতিবিধি কড়া নজরদারি করে রাখে। বর্মাছড়ি আর্যকল্যাণ বনবিহারের পাশে চলছে অপ্রয়োজনীয় সেনা ক্যাম্প স্থাপনের পাঁয়তারা অভিযোগ উঠেছে।

এতে ল²ীছড়ির বর্মাছড়িতে রাস্তা অবরোধ করে সেনাবাহিনীর টহল কার্যক্রম ব্যাহত করার চেষ্টার পাল্টা অভিাযোগ চলছে। গত বুধবার(২২শে অক্টোবর ২০২৫) সকাল থেকে সেনারা গ্রামবাসীর সৃজিত গাছের বাগান কেটে সেনা ক্যাম্প তৈরির জায়গা প্রস্তুত করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাগানের বেশকিছু সৃজন করা বেশ কিছু গাছ সেনারা কেটে দিয়েছে। যে ভাবে হোক সেনা ক্যাম্প স্থাপনের জন্য জায়গা প্রস্তুুত করতে গিয়ে গ্রামবাসীর সৃজিত বাগানের বেশ কিছু গাছ কেটে দেওয়া হয়েছে।

গত ১৮ই অক্টোবর খিরাম আর্মি ক্যাম্প থেকে ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মো: সাইফুর রহমান তুর্যোর নেতৃত্বে ২০জনের একটি সেনা দল বর্মাছড়ি বাজার এলাকায় যায়। এরপর থেকে সেনারা উক্ত স্থানে তাঁবু খাটিয়ে রাখে। তবে রাতে তারা অবস্থান করেন ফটিকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে। শুকনাছড়ি সাব-জোন থেকে ২০জনের একটি সেনাদল হুদুকছড়িতে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। সেনারা উক্ত জায়গায়ও তাঁবু খাটিয়ে রেখেছে।