খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা

খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে মশাবাহিত রোগ ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি থেকে ১১ই জুলাই পর্যন্ত বান্দরবানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৫জন।

এর মধ্যে গত সোমবার(১০ই জুলাই) বান্দরবানের থানচি উপজেলার কাইতং পাড়ায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে মাকে ডাকতে ডাকতেই লেংরাই নামে ৯বছর বয়সী এক শিশু মারা যায় বলে জানা গেছে। ফলে এতে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

বান্দরবান জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এই সময়ের মধ্যে বান্দরবান সদর উপজেলায় ১৪৭, আলীকদমে ৭৩৪, নাইক্ষ্যংছড়িতে ২৬৬, রুমায় ৪০২, থানচিতে ৫৯৪, লামায় ৬১৯ ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় ১৫৫ এবং বিচ্ছিন্নভাবে ১৬জনসহ মোট ২হাজার ৯৩৩জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, এক সপ্তাহে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৪০জন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছেন। অনেকে সুস্থ হয়ে বাাড় ফিরে গেছেন, বাকিদের চিকিৎসা চলছে।
তিন পার্বত্য জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বান্দরবানে গত বছরের প্রথম ছয় মাসে ৫হাজার ৬৯২জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। মারা যান সাতজন। এ বছর ২হাজার ৯৩৩জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের পাশাপাশি মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে জেলাজুড়ে।

বান্দরবান জেলায় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বরত চিকিৎসক শাহরিয়ার তানভির আহম্মেদ বলেন, জেলার সাত উপজেলার মধ্যে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে বেশি রয়েছে লামা, আলীকদম ও থানচি উপজেলা। সেখানে চিকিৎসকেরা কাজ করছেন।

বান্দরবানের সিভিল সার্জন মো: মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন হতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের একাধিক চিকিৎসক টিম ও মাঠকর্মীরা কাজ করছেন।’

অপরদিকে, বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে খাগড়াছড়ি জেলায় গত ১লা জুন থেকে ১১ই জুলাই পর্যন্ত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ১২১জন।
খাগড়াছড়ি জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জুন মাসে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৭১জন আর চলতি মাসের ১১ই জুলাই পর্যন্ত ১০দিনে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন ৫০জন। তবে আক্রান্তদের মধ্যে এখনো কেউ মারা যাননি বলে জানিয়েছে সিভিল সার্জনের কার্যালয়।

সরকার ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে এতদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়া নির্মুলের কথা বলা হলেও নতুন করে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধিতে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, দায়িত্বশীলরা এতদিন বলেছেন, পার্বত্য এলাকা থেকে ম্যালেরিয়া বিদায় নিয়েছে। তাহলে এখন কোথা থেকে এলো?

এদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে ম্যালেরিয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুও, এতে আক্রান্ত শতাধিক বিভিন্ন স্তরের মানুষ। এক সময়ের ম্যালেরিয়ার হটস্পট ছিল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে সেই অবস্থার অনেক উন্নতিও ঘটে। কিন্তু হটাৎ করেই পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়িতে মশার কামড়ে রোগ বালাই বৃদ্ধি পেয়েছে।

ম্যালেরিয়ার সাথে অনেকটা পাল্লা দিয়েই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও। গেলো এক মাসে পাহাড়ি এই জেলায় দুই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। জেলার দুই উপজেলায় দ্রুুত বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে জনগণকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। বিগত জুন ও চলতি মাসের এই পর্যন্ত প্রাণঘাতি ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন শতাধিক মানুষ।

স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব পুরো জেলর ৯টি উপজেলাজুড়ে থাকলেও ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশির ভাগই মাটিরাঙ্গা পৌরসভা এবং গুইমারা উপজেলার জালিয়াপাড়া এলাকায়। তাই মাটিরাঙ্গা পৌরসভা এলাকাকে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসার পাশাপাশি অনেকে যাচ্ছেন আধুনিক জেলা সদর হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
স্বাস্থ্য বিভাগের মতে, বর্ষার এই সময়ে ম্যালেরিয়া কিছুটা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে ঈদে ঢাকা ফেরত লোকজন থেকে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে বেশি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিষ্কার—পরিচ্ছন্নতার অভাব ও মশক নিধন কার্যক্রম না থাকায় এমন অবস্থা। মশা নিধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস স্থানীয় পৌর মেয়রের।

খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্ধু চৌধুরী মশার বাড়ার কথা স্বীকার করে বলেন, অচিরে মশা নিধন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। আশাকরি পৌরবাসী নিজ আংগিনায় পরিষ্কার—পরিচ্ছন্নতা রেখে পৌর কতৃর্পক্ষকে সহযোগীতার বাড়িয়ে আসবে।

খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন জানান, পরিস্থিতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুুতির কথা বলছে স্বাস্থ্য বিভাগ। মশার বিস্তার ঠেকাতে মশক নিধন কার্যক্রম জোড়ালো করতে হবে। বর্তমানে খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ডেঙ্গুতে ৭জন রোগী চিকিৎসাধীন থাকলেও ম্যালেরিয়া রোগি ভর্তি নেই।

খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা ডা: রিপল বাপ্পি চাকমা বলেন, ‘যত্রতত্র ময়লা—আবর্জনা ফেলা, বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার না রাখা এবং জমানো পানি অপসারণ না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসব বিষয়ে সচেতন হলে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসবে।’