খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু উপলক্ষে বৈসাবি’র বর্ণাঢ্য র‍্যালি

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু উপলক্ষে বৈসাবি’র বর্ণাঢ্য র‌্যালি ও ডিসপ্লে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্ণিল আয়োজনে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে উদ্বোধন হয়েছে পাহাড়বাসীর প্রাণের উৎসব বৈসাবি। বুধবার (৯ই এপ্রিল) সকালে বৈসাবি উপলক্ষে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে এ র‌্যালির সুচনা করা হয়।

এ উৎসবের উদ্বোধন করেন খাগড়াছড়ি ২০৩রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আমান হাসান। সকাল ৯টায় আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধনের পরপরই উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়ে খাগড়াছড়িতে। পরে পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ থেকে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালী বের হয়। র‌্যালিতে ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা ও বাঙালী তরুণ-তরুণীরা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক, বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নেচে-গেয়ে এতে অংশ নেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, রিজিয়ন কমান্ডারের সহ-ধর্মিনী ফারজানা আক্তার চৌধুরী, ডিজিএফআই’র ডেট কমান্ডার কর্ণেল আতিকুর রহমান, জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার, সদর সেনা জোন কমান্ডার লে: কর্নেল খাদেমুল ইসলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত প্রত্যাগত শরনার্থী প্রত্যাবাসন ও পুর্ণবাসন বিষয়ক টাস্কফোসে’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কৃঞ্চ চন্দ্র চাকমা, ব্রিগেডের জিটু আই মেজর মোস্তফা আরেফিন।

এনএসআইয়ের যুগ্ন-পরিচালক নাছির মোহাম্মদ গাজী পুলিশের এএসপি মোহাম্মদ মিজান, বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফরিদ মিয়া, সিভিল সার্জন ডা: ছাবেরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা অংশ নেন।

এসব জনগোষ্ঠীর নারী পুরুষ তাদের সংস্কৃতি র‌্যালিতে তুলে ধরেন। পাশাপাশি তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-আশাক পরিধান করে নেচে গেয়ে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করেন।

র‌্যালীতে চাকমা মারমা ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর সরকারি-বেসরকারি লোকজন অংশগ্রহণ করে।

র‌্যালিটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে পুরো টাউন হলের সামনে গিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ডিসপ্লে’র মাধ্যমে প্রদর্শন করে।

বৈসাবি উৎসবের মধ্য দিয়ে পাহাড়ী-বাঙ্গালীর মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি ও ঐক্য আরো সু-দৃঢ় হোক এই প্রত্যাশা সকলের।বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ উপলক্ষ্যে জেলাতে বর্ণাঢ্য র‍্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গত মঙ্গলবার(০৮ই এপ্রিল) সকালে খাগড়াছড়ি চেঙ্গী স্কোয়ার থেকে খাগড়াছড়ি সার্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটি’র আয়োজনে পাহাড়ি সকল জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত অংশগ্রহণে বর্ণাঢ্য র‍্যালি বের করে।

বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু(বৈসাবি) উৎসব:
বৈসাবি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান ৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সমাজের বর্ষ বরণ উৎসব। এটি তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি। এই উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুব, বৈসু বা বাইসু, মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত। বৈসাবী নামকরণও করা হয়েছে এই তিনটি উৎসবের প্রথম অক্ষর গুলো নিয়ে। বৈ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, সা শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং বি শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। এই তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো ‘বৈসাবি’।

চাকমা সম্প্রদায়ের বিজু:
চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাগণ এ উৎসবটি ৩দিন ধরে বিজু পালন করেন। এ ৩দিন হল চৈত্রের শেষ ২দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন। এর মাঝে চৈত্রের শেষ দিনটি এই উৎসবের মূল আকর্ষণ। এ দিন ঘরে ঘরে পাঁত্রিশ প্রকারের সবজি সহকারে বিশেষ খাদ্য পাজন রাঁধা হয়। তারা বিশ্বাস করেন এই পাঁচনের দৈব গুণাবলী আগত বছরের অসুস্থতা ও দুর্ভাগ্য দূর করবে।

এদিন বিকেলে খেলা হয় ঐতিহ্যবাহী খেলা ঘিলা, বৌচি ইত্যাদি। তরুণীরা পানিতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে প্রার্থনা করে। বিজু উৎসবের এই ৩দিন কেউ কোনো জীবিত প্রাণী বধ করেন না।

মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই:
মারমা ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্টি বা আদিবাসীরা বর্ষবরণের এই উৎসব কে পালন করেন সাংগ্রাই নামে। এ উৎসব চলে ৩দিন ধরে। মারমাগণ সবাই বুদ্ধের ছবি সহকারে নদীর তীরে যান এবং দুধ কিংবা চন্দন কাঠের ডাব জল দিয়ে এ ছবিটিকে স্নান করান। তারপর আবার এই ছবিটিকে আগের জায়গায় অর্থাৎ মন্দির বা বাসাবাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

মারমা সম্প্রদায় সেই আদিকাল থেকে অন্যান্য স¤প্রদায় থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানাতে ক্যাপা বা গানে মংগল যাত্রাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে আসছে, যা মারমা ভাষায় সাংগ্রাই নামে পরিচিত। মূলত ‘সাক্রইঅ'(সাল) শব্দ থেকেই ‘সাংগ্রাই’ শব্দ এসেছে বলে ধারণা করা হয়। যা বাংলাই ‘সংক্রান্তি’ বলে পরিচিত।

মারমা স¤প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই জ্যা’র(মারমা বর্ষপঞ্জি) গঠনের মাধ্যমে সাংগ্রাইয়ের দিন ঠিক করা হয়ে থাকে। মাইংমা সাক্র ১৩৫৯খ্রিষ্টাব্দের আগে থেকেই এ ‘সাক্রইঅ’ বা সাল গণনা করা হয়, যা ‘জ্যা সাক্রইঅ’ নামে পরিচিত।

সাংগ্রাইয়ের উৎপত্তি নিয়ে মারমা ভাষায় বিভিন্ন কল্পকাহিনী বিদ্যমান রয়েছে, যা এখনো মারমা বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে প্রচলিত। কবে থেকে মারমাদের সাংগ্রাই উদযাপন শুরু হয় এ ব্যাপারে সঠিক কোনো ইতিহাস এখনো পাওয়া যায়নি। তবে মাইংমা সাক্র সাংগ্রাই উৎসবটি মারমারা তিন দিনব্যাপী উদ্যাপন করে।

সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিনকে মারমা ভাষায় ‘সাংগ্রাই আক্যা’ বা ‘পাইংছোয়ায়(সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিন পুষ্প আহরণ)। দ্বিতীয় দিনকে ‘সাংগ্রাই বাক্'(সাংগ্রাইয়ের দিন) এবং তৃতীয় দিনকে ‘সাংগ্রাই আপ্যাইং'(সাংগ্রাই বিদায়) নামে পরিচিত। এই তিন দিন মারমারা নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, পাচন খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে।

সাংগ্রাই আক্যা বা পাইং ছোয়ায়(সাংগ্রাইয়ের প্রথম দিন বা পুষ্প আহরণ) এই দিনে আসন্ন পবিত্র সাংগ্রাইকে সামনে রেখে মারমারা নিজেদের বাড়ি, বাড়ির আঙিনা ও আশপাশের রাস্তা পরিষ্কার-পরিছন্ন করে। এদিন মারমারা সবাই মিলে পবিত্র সূত্রাদি পাঠের মাধ্যমে বিহার পরিষ্কার করে থাকে।

সাংগ্রাই বাক্(সাংগ্রাইয়ের দিন) এই দিনে খুব ভোর থেকে গ্রামে গ্রামে মারমাদের মধ্যে নিজ নিজ উদ্যোগে পুষ্প আহরণের ধুম লাগে। এদিন যে যত বেশি পুষ্প আহরণ করে বুদ্ধের কাছে পুষ্পপূজা করতে পারবে সে তত বেশি পুণ্য অর্জন করবে বলে মারমাদের বিশ্বাস। সাংগ্রাইয়ের তিন দিনকে উপলক্ষ করে অনেকে বিহারে গিয়ে তিন দিনের জন্য অষ্টমশীল পালন করে উপাসনা করেন। আবার অনেকে এদিন খুব ভোরে বিহারে গিয়ে বুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে ‘অংরুং ছোইং'(ভিক্ষুদের সবার খাবার) দান করেন। বিহারে অবস্থানরত ভিক্ষুরা এদিন ধর্ম দেশনা দিয়ে থাকেন।

দুপুর গড়ালে ‘দোয়াইং'(ভিক্ষুদের দুপুরের খাবার)-এর দানানুষ্ঠান শুরু হয়। অতঃপর ভিক্ষুদের দোয়াইং গ্রহণ শেষ হলে বিকেলে ‘নাইংসা'(সুগন্ধিকাব বিশেষ)-এর পানি, ডাবের পানি দিয়ে বুদ্ধ স্নান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

সাংগ্রাই আপ্যাইং(সাংগ্রাইয়ের বিদায়) এই দিনটি মারমাদের কাছে নতুন বছরের শুরু বলে ধারণা করা হয়। এদিনেও পুষ্পপূজা, দোইংতা(আহার দান) করা হয়। এদিনে বিহারে আসা পুণ্যর্থীদের মধ্যে পিঠা বিতরণ করা হয়। গ্রামে গ্রামে প্রতিবেশীদের মধ্যে পিঠা বিনিময় করা হয়। একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। এদিন গ্রামে বয়োজ্যেষ্ঠদেরও পিঠা দান করা হয়।

ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বৈসু:
বৈসু ত্রিপুরা স¤প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ দুইদিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এই তিনদিনব্যাপী এ উৎসব পালন করা হয়। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব বৈস। প্রথম দিনকে বলা হয় হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিনকে বৈসুমা এবং তৃতীয় বা শেষ দিনটিকে বলা হয় বিসি কতাল।

মূলত আগামী দিনের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়। তিনদিন ব্যাপী এই বৈসুর প্রথম দিন হারি বৈসু। হারি বৈসুতে ভোর বেলায় ফুলগাছ থেকে ফুল তোলার প্রতিযোগিতা চলে। সেই ফুল দিয়ে বাড়ি সাজানো হয় এবং পাশাপাশি সেই ফুল মন্দির এবং পবিত্র স্থানে দিয়ে শ্রদ্বা নিবেদন করা হয়।

চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্টি বা আদিবাসীদের গণত্মক বা পাচন:
বৈসাবি উৎসবে রান্না হয় মূলত উপজাতিদের প্রধান ও জনপ্রিয় খাবার ‘গণত্মক বা পাচন’ এ খাবার সবার ঘরে রান্না হয়। এর পাশাপাশি নানা ধরনের পিঠা, সেমাই, মুড়ি-চানাচুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ও ঠান্ডা পানীয় জলের আয়োজন করা হয়। মিশ্র শাক-সবজি রান্না হয় মূলত ২৫ থেকে ৩০ধরনের সবজির সংমিশ্রণে। তবে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বনজঙ্গলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সবজির ধরনের পরিমাণও কমে যাচ্ছে।

আর্কষনীয় ঐতিহ্যবাহী মারমাদের জলকেলী বা পানি উৎসব: মারমাদের জলকেলী বা পানি উৎসবটি প্রতিটি এলাকাতেই কমবেশি জনপ্রিয় হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে ১৪এপ্রিল মারমা উন্নয়ন সংসদ পান খাইয়া পাড়ায় ও বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদ টিটিসে সংলগ্ন পেন্ডেলে ১৩এপ্রিল পৃথকভাবে জলকেলী বা পানি উৎসবটি আয়োজন করে থাকে।

বান্দরবানে মারমা শিল্পী গোষ্টির আয়োজনে বোমাং রাজার মাঠে ১৫এপ্রিল জলকেলী বা পানি উৎসবটি পালন করে থাকে। রাংগামাটি পার্বত্য জেলাতে ১৬এপ্রিল মারমা সংস্কৃতি সংস্থা উদ্দ্যোগে এবার বাংগালহালিয়ায় জলকেলী বা পানি উৎসবটি পালন করবে। এটিও বৈসাবী উৎসবেরই একটি অংশ। এ উৎসবে ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্টি বা আদিবাসীরা বর্ষবরণের সবাই সবার দিকে পানি ছুঁড়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন যেন গত বছরের সকল দুঃখ, পাপ ধুয়ে যায়।

এর আগে অনুষ্ঠিত হয় জলপূজা। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয়। তা ছাড়া মারমা যুবকরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করে। ভালোবাসার এমন বর্ণাঢ্য উচ্ছ¡াস, এমন বর্ণাঢ্য অনুভূতি আর কোন ‘গান্ধর্ব্য’ শুধু বৈসাবিতেই সম্ভব।