খাগড়াছড়ি লক্ষ্যাছড়ির সজীব চাকমা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসহায় ছাত্রের কষ্টের গল্পটা ক’জনে জানে

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা অত্যন্ত দুর্ঘম লক্ষ্যাছড়ি উপজেলার মায়াবি চেহারা সজীব চাকমা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রের কষ্টের গল্পটা ক’জনে জানে, কতজনেওবা শুনেছেন। দুর্ঘমতা জেলার লক্ষ্যাছড়ি উপজেলার শিলাছড়ি গ্রামের সন্তান বাস্তব কথা সজীব কান্তি চাকমা।

তবে লোকালয়ে থাকার মতো ঘর ছিল না তাঁদের। কারণ তাঁরা যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির জেলেদের মতো গরীবের মধ্যে আরো গরীব। মা-বাবা দুজনই জুমচাষি।

দিন মজুরিও করতেন। থাকতেন পাহাড় চূড়ায় ছোট একটি জুমঘরে। সেখানেই জন্ম সজীবের। উঁচু-নিচু বাধার পর্বত পেরোলে বসত ঘর। পাহাড়ের সজীব নৈসর্গিক নীল সবুজের খেলা দেখে কেটেছে শৈশব।

কষ্টের জীবন মানেই যুদ্ধ-এটা সজীব কান্তি চাকমার চেয়ে ভালো আর কে জানে। ৪ঠা নভেম্বর দিনটি অক্ষয় হয়ে থাকবে এই তরুণের মানসপটে। শিশু কিশোর শৈশব থেকে পাওয়া অপমান, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর ঘাত-প্রতিঘাত পেছনে ফেলে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষা পড়ার জীবন শুরু করেছেন।

২০২৩-২৪সেশনে শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, লোকপ্রশাসন বিভাগে। আফসোস একটাই খবরটা মাকে জানাতে পারেননি। ছলছল চোখে বলছিলেন, মা শুনলে কী যে খুশি হতেন।

মা পরলোকগত চির নিন্দ্রায় আকাশের ঠিকানায়। বাবা যেন থেকেও নেই। কয়েক মাস পর নতুন সংসার পাতলেন তিনি। সেই থেকে আর কখনো বাবার বাড়ি মুখো হননি সজীব। তিনি বড় হতে লাগলেন দাদু-দাদির কাছে। তাঁদের সংসারেও নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তবু নাতিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন।

বলতেন, যত কষ্টই হোক, পড়াশোনা ছেড়ো না দাদু। শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষায় জাতির মেরুদন্ড, শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজে ও দেশের প্রকৃত কর্মময় শিখরে অবস্থান করে নিতে হবে।

দুর্ঘম লক্ষ্যাছড়ি কিন্ডারগার্টেন-সজীবের প্রথম স্কুল। তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর ভর্তি হলেন লক্ষ্যাছড়ি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে দাদুকে বাঁশ, গাছ ও অন্যান্য বিক্রিতে সাহায্য করতেন।

স্কুলে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ৪০০টাকা মজুরিতে রাজমিস্ত্রির সহকারি জোগালির কাজ করতেন সজীব। নিজের খরচ চালিয়ে দাদুর সংসারেও দিতেন। বার্ষিক পরীক্ষার পর গেলেন চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বেসরকারি মালিকানা ফ্যাক্টরিতে চাকুরী করতে।

একটা সুতার কারখানায় মাসখানেক কাজ করে পাঁচ হাজার টাকা পেলেন। মাটি কাটার কাজও করেছেন মাস খানেক। যেখানে যেটা পেতো সেটি কাজ করে আহার থেকে শুরু করে কাপড়-চোপড় পরিধানসহ নানান ভাবে কাজে লাগাতো।

অসহায় সজীব বললেন, ভীষণ কঠিন ছিল সেসব দিন। নতুন জুতা কেনার মতো টাকা ছিল না। তখন এক বন্ধুকে বললাম, ‘তুই আমাকে এক জোড়া জুতা কিনে দে।’ সে কিনে দিয়েছিল। তার প্রতি সাড়া জীবনের কৃতজ্ঞতা থাকলো।

সজীবকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শান্তানু চাকমা। এইচএসসি পরীক্ষার পর চলে গেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সেখানে জুম একাডেমিতে বিনা পয়সায় কোচিংয়ের সুযোগ পেলেন।

ভালো ভাবে প্রস্তুুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার ঠিক আগে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এই অবস্থায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিলেন। হলো না। শেষে সুযোগ পেলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মিলে ভতির টাকা জোগাড় করে দিয়েছিল অদম্য এই প্রতিভা তরুণকে।

তবে ভর্তি হলেও শঙ্কার মেঘ কাটেনি সজীবের। আপাতত একটা মেসে উঠেছেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ কিভাবে চলবে, এ নিয়ে চিন্তায় আছেন। বললেন, এ পর্যন্ত আসতে অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। আমৃত্যু তাদের মনে রাখব।

ভবিষ্যতে আমার মতো দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো সচেতন মহলের কাছে আহবান জানান। পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ্ঞলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়সহ সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে উদ্দ্যোগে মেয়াদি অথবা এককালিন আর্থিক সহযোগীতা পেলে অসহায় ও অসছল পরিবারে গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ-সৃষ্টি হবে বলে সচেতন মহলের অনেকের মতামত।