খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কাউন্সিল: সুনয়ন সভাপতি ও সুনীল সম্পাদক
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর ২৫তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে। গত ৩০-৩১শে মার্চ ২০২১খ্রি: দুই দিনব্যাপী চলা এই কাউন্সিল ৬টি পর্বে সম্পন্ন হয়। কাউন্সিলে সুনয়ন চাকমা সভাপতি ও সুনীল ত্রিপুরা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
৩০শে মার্চ ২০২১ সকাল ৯টায় নিজস্ব শিল্পীদের পরিবেশনায় দলীয় সঙ্গীত ‘পাহাড়ি ছাত্র ছাত্রী দল’ গান পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে কাউন্সিল অধিবেশন উদ্বোধন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ)-এর অন্যতম সংগঠক ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমেন চাকমা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন পিসিপি বিদায়ী কমিটি’র সভাপতি বিপুল চাকমা।
পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আত্মোৎসর্গকারী সকল বীর শহীদদের উদ্দেশ্য শোক প্রস্তাব পাঠ করেন পিসিপি কেন্দ্রীয় সদস্য রিপন জ্যোতি চাকমা। শোক প্রস্তাব শেষে সকল শহীদদের শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে দুই মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
দুই দিনব্যাপী চলা কাউন্সিলে প্রথম অধিবেশনে পিসিপি’র সভাপতি বিপুল চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সুনয়ন চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফ-এর অন্যতম সংগঠক সুমেন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জিকো ত্রিপুরা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক নীতি চাকমা প্রমূখ।
ইউপিডিএফ নেতা সুমেন চাকমা বলেন, পাহাড়ি জনগণ এখন নিজ ভূমিতে পরবাসী। সরকার নামে বেনামে পাহাড়ি জনগণের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নিচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও বহিরাগত সেটলার বাঙালি কর্তৃক প্রতিনিয়ত মা-বোনের ইজ্জ্বত লুন্ঠন হচ্ছে, পাহাড়ে প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সর্বোপরি পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দেশের সকল সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূকে বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
পিসিপি’র নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাদেরকে সকল নেতা-কর্মীকে নিরন্তর সংগ্রামের মাধ্যমে সংগঠনে ঠিকে থাকতে হবে। লড়াই সংগ্রামের পথে যে কেউ টিকে থাকতে পারে না। সমাজের যারা চিন্তা চেতনার অগ্রসর, যারা অগ্রগামী তারাই পার্টি ও সংগঠনের যুক্ত হন। তারা জাতীয বৃহত্তর স্বার্থের জন্য নিজের সকল কিছুকে বিসর্জন দিয়ে সকল কিছু ত্যাগ করে অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে সামিল হন। তারা নিজেদের জীবনকেও আত্মোৎসর্গ করতে সব সময় প্রস্তুুত থাকেন।
তিনি আরো বলেন, বিশ্বের যে কোন দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে ছাত্ররা ভূমিকা পালন করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামেও ৯০দশকের পিসিপি’র নেতা-কর্মীরা দালালদের প্রতিরোধ করেছিল। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। তারা নিজের স্বার্থের জন্য বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে বিকিয়ে দিচ্ছে, জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করতে নানান চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে জনগণকে সে সব দালাল-প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিহত করতে হবে। গ্রামে গঞ্জে, পাড়া মহল্লায় প্রতিরোধের দুর্গ তুলতে হবে।
তিনি সকল কিছু বিসর্জন দিয়ে সাহস শক্তি সঞ্চার করে শত্রু ও জাতীয় দালাল-প্রতিক্রিয়াশীলদের মোকাবেলার জন্য প্রস্তুুত থাকতে এবং আত্ম সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামকে বেগবান করতে ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।
ছাত্র নেতা বিপুল চাকমা বলেন, পিসিপি একটি সংগ্রামের নাম, আবেগের নাম, ঐতিহাসিক নাম। এই পিসিপি’র সাথে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম, আবেগ, ঐতিহাসিক নানান ঘটনা। ২০শে মে ১৯৮৯সালে পিসিপি গঠন হওয়ার পর হাটি হাটি পা পা করে নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে ৩২টি বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এই যাত্রা পথে পিসিপি হারিয়েছে অনেক সহযোদ্ধা। তারা হয়তো আজকে নেই কিন্তুু তাদের আদর্শ আমাদের প্রত্যেকটি সহযোদ্ধাদের মধ্যে জড়িয়ে আছে। সে সকল শহীদদের রক্ত আমাদের ধমনীতে প্রবাহিত রয়েছে। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না, তাদের রক্তের সাথে বেঈমানি করতে পারি না। সে জন্য সরকার-রাষ্ট্রীয় বাহিনী দমন-পীড়ন ও নানা ষড়যন্ত্র চালালেও পিসিপি নেতা-কর্মীদের তাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। তারা সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে পিসিপি’র লক্ষ্য পূরণে অবিচল রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে দানবীয় কবলে রাখা হয়েছে। পাহাড়ি জনগণকে ধ্বংস করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদে একটি দালাল-প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সৃষ্টি করে খুন-গুম-অপহরণের মত ঘটনা ঘটিয়ে পাহাড়ে ত্রাসের রাজত্বে পরিনত করেছে। সুতরাং পাহাড়ি জনগণকে এই দানবীয় কবল থেকে রক্ষা করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। লড়াই সংগ্রাম জোরদার করতে হবে।
তিনি আগামী দিনে সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পিসিপি নেতা-কর্মীদের প্রস্তুুত থাকার জন্য আহ্বান জানান। একই সাথে তিনি শাসকগোষ্ঠীর সকল অন্যায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দঁাড়ানোর জন্য ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
যুব ফোরাম নেতা জিকো ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্তিত্বকে ধ্বংস করতে সরকার নানাভাবে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যা”েছ। পাহাড়িদের মধ্যে দালাল সৃষ্টি করে রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা করছে সাজেক, চিম্বুক পাহাড়ে পর্যটন নির্মাণ করে পাহাড়িদের উ”েছদের পঁায়তারা চালাচ্ছে। তিনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ছাত্র ও যুব সমাজকে সোচ্চার হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। নিজের ঘরে বসে থেকেও আমাদের নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, হামলার শিকার হতে হচ্ছে, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নারী সমাজকে জেগে উঠা প্রয়োজন। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আত্মসমভ্রম রক্ষার্থে আন্দোলন গড়ে তোলতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের পতাকা তলে সমবেত হওয়ার জন্য নারী সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।
পরের অধিবেশনগুলোতে পিসিপি সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, অর্থ সম্পাদক ও দপ্তর সম্পাদক রিপোর্ট পেশ করেন এবং সে রিপোর্টের ওপরে তিন পার্বত্য জেলা ও চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উপস্থিত প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও শাখা কমিটি প্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকার সাংগঠনিক রিপোর্ট ও সফলতা দুর্বলতা তুলে ধরেন।
২য় দিনের শেষ অধিবেশনে সুনয়ন চাকমাকে সভাপতি, সুনীল ত্রিপুরাকে সাধারণ সম্পাদক ও অমল ত্রিপুরাকে সাংগঠনিক সস্পাদক করে ২৩সদস্য বিশিষ্ট একটি নতুন কমিটি ঘোষণা করলে উপস্থিত প্রতিনিধিরা তুমুল করতালি মাধ্যমে পাশ করেন।
নতুন কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান পিসিপি বিদায়ী কমিটি সভাপতি বিপুল চাকমা। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক শুভাশীষ চাকমা স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন