খাগড়াছড়িতে পাহাড় দখলকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা, সম্প্রীতি বজায়ের আহ্বান প্রশাসনের
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা মাটিরাঙ্গা উপজেলাতে তবলছড়ি ও তাইন্দং এলাকার পাহাড় দখলকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনা পাহাড়ি-সেটেলার বাংগালি সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান প্রশাসনের। জেলার মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি ও তাইন্দং এলাকায় সৃষ্ট উত্তেজনা নিরসনে ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ২৯৮নং আসনে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এ সময় তারা সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানান।
মঙ্গলবার(৬ই এপ্রিল) দুপুরে তারা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে স্থানীয়দের নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সংসদ সদস্য, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আজিজ বলেন, আমরা এ এলাকায় প্রত্যেক ঘটনা গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখছি। আপনার সর্বাত্মক নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব আমাদের। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে বাস করুন। আর যারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনের প্রয়োগ করা হবে।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস স্থানীয়দের উদ্দেশে বলেন, যে জমি বিগত ৫-১০বছর ধরে যে খাচ্ছে সেই খাবে। তবে এ কারণে কেউ যদি মনে করে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাহলে আমাদের কাছে আসতে পারেন। আমরা তদন্ত করে সিদ্ধান্ত দেব। কিন্তু নিজ থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়া যাবে না যে এ জমি আমার। এলাকায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর রয়েছে জানিয়ে তিনি কোনো রকম গুজব না ছড়ানোর আহ্বান জানান।
গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য সন্ত্রাসী দল দায়ী। কোনো অবস্থাতে পাহাড়ি কিংবা বাঙালি দায়ী নয়। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করুন। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্মিলিতভাবে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি বলেন, একটি গোষ্ঠী সব সময় পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার পাঁয়তারা চালিয়ে আসছে। যারা নতুন করে ষড়যন্ত্র করছে, পাহাড়ি বাঙালি সহাবস্থান নষ্ট করতে চাচ্ছে তাদের কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়া হবে না। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করবো। পাহাড়ি-বাঙালি যে পক্ষের হোক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করতে দেয়া হবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ উল্লেখ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান(প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি আরো বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আলাদা কোন দেশ নয়। পাহাড়ী-বাঙালী আমরা সকলেই বাংলাদেশী। আমাদের পরিচয় আমরা বাংলাদেশী। এ পরিচয়েই আমরা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ যেন মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে জন্য প্রধানমন্ত্রী কাজ করে যাচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মাটিরাঙ্গার তবলছড়ির লাইফু কুমার কার্বারী পাড়ায় বাঙালী কৃষকদের উপর ইউপিডিএফের স্বশস্ত্র হামলার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনের আগে স্থানীয় পাহাড়ী-বাঙালী সম্প্রদায়ের সাথে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন।
মঙ্গলবার(৬ই এপ্রিল) দুপুরের দিকে তবলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ হলরুমে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস, যামিনীপাড়া বিজিবি’র অধিনায়ক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো: আব্দুল আজিজ প্রমুখ বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন।
ইউপিডিএফের সশস্ত্র কর্মীরা যদি বাঙ্গালীদের উপর কোন ধরনের হামলা চালায় তাহলে বাঙ্গালীদের বিক্ষোভ মিছিল না করে প্রশাসনের সহযোগিতা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, পাহাড়ি-বাঙ্গালীদের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখতে যা যা করা দরকার প্রয়োজনীয় সবকিছু করবে সরকার।
পাহাড়ের শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পাহাড়ী-বাঙালীদের মিলেমিশে বসবাস করার আহ্বান জানিয়ে বক্তারা বলেন, বাঙালিদের উপর হামলার ঘটনায় যারা মসজিদ মাইকে গুজব ছড়াচ্ছে তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না।
এসময় মাটিরাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো: রফিকুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার(ভূমি) মিজ ফারজানা আক্তার ববি, মাটিরাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আলী, মাটিরাঙ্গা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এম হুমায়ুন মোরশেদ খান, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য হিরন জয় ত্রিপুরা, মো: মাইন উদ্দিন, মো: আব্দুল জব্বার, তবলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: আব্দুল কাদের ও তাইন্দং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো: হুমায়ুন কবীর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভা শেষে গত রোববার(৪ঠা এপ্রিল) সেটেলার বাঙালী কৃষকদের উপর ইউপিডিএফের সশস্ত্র হামলার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত প্রত্যাগত শরনার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি। এসময় গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস, যামিনীপাড়া বিজিবি’র অধিনায়ক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো: আব্দুল আজিজসহ সামরিক-বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগন তাঁর সাথে ছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত রোববার সকালে তাইন্দং ও তবলছড়ি ইউনিয়নের মধ্যবর্তী লাইফুকার্বারী পাহাড় ও জঙ্গলে পাহাড়ি ভোগ দখলীয় জায়গায় সেটেলার কৃষকরা অবৈধ দখলে কাজ করতে গেলে সেখানে একদল অস্ত্রধারী তাদের আটকে রেখে মারধর করে এবং ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ সময় অস্ত্রধারীরা ওই এলাকায় যেতে নিষেধ করেন। তাদের হামলায় ৪/৫জন আহত হয়। তারা খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা নেয়। এর একদিন পর গত সোমবার(৫ই এপ্রিল) রাতে অস্ত্রধারীরা একটি দল বাঙালি অধ্যুষিত গ্রামে ঢুকে মারধর করার অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। পরে গ্রামের লোকজন একত্রিত হলে তারা পালিয়ে যায়। এদিকে রাতেই স্থানীয়রা একজোট হয়ে বিক্ষোভ করে।
তবলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের(ইউপি) চেয়ারম্যান মো: আব্দুল কাদের বলেন, বাঙালিরা জঙ্গলে কাজ করতে গেল ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা বিনা উস্কানিতে তাদের ওপর হামলা ও গ্রামে ঢুকে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে। উগ্র সন্ত্রাসীরা এলাকার শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে। আমরা স্থানীয়দের বুঝিয়ে শান্ত রেখেছি।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ-প্রসিত) এর প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান নিরন চাকমার বিবৃতিতে সেটেলারদের উপর হামলা ও আতংক সুষ্টির চেষ্টা অস্বীকার করে মিথ্যা-বানোয়াত-অপবাদ থেকে প্রচারে বিরত থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, মূলত: ১৯৮১-৮৬সালে বিরাজমান পরিস্থিতির ক্ষতি গ্রস্থ এলাকাটি পাহাড়ি প্রথাগত ভোগ দখলীয় গরীব অসহায় ত্রিপুরা পাড়ার নিবাস। ক্ষমতাসীন দলের লুকিয়ে থাকা লেবাস জামায়াত শিবির চক্র-হেফাজত ইসলামীর ভূমি খোকোরা পাহাড় অবৈধভাবে দখল করতে মরিয়া হইয়া গেলে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে রোসানলে পড়ে যায়। আবার পবিত্র মসজিদের গিয়ে মিথ্যা হামলার বিষয়ে মাইকে হৈ-চৈ করা ও প্রতিবেশীদের আতংক সৃষ্টি করা গুরুতর অপরাধ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই সাজানো পূর্ব পরিকল্পিত ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
এদিকে পার্বত্য খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার তবলছড়ির লাইফু কুমার কার্বারী পাড়ায় বাঙালি কৃষকদের উপর এলাকার হামলায় আহত কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ। বুধবার(৮ই এপ্রিল) বিকেলের দিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রæু চৌধুরী অপু’র পক্ষে পরিষদের সদস্য হিরন জয় ত্রিপুরা মাটিরাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম হুমায়ুন মোরশেদ খান ও সাধারণ সম্পাদক সুবাস চাকমার হাতে আহতদের জন্য চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে দুই লক্ষ টাকা তুলে দেন। এসময় মাটিরাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো: রফিকুল ইসলাম, মাটিরাঙ্গা পৌরসভার মেয়র মো: শামছুল হক, মাটিরাঙ্গা পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি মো: হারুনুর রশীদ ফরাজী ও মাটিরাঙ্গা পৌর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মো: আলাউদ্দিন লিটন ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, গেল রোববার(৪ঠা এপ্রিল) দুপুরের দিকে সীমান্তবর্তী মাটিরাঙা উপজেলার তবলছড়ির লাইফু কার্বারী পাড়া এলাকায় কচু চাষের জন্য পাহাড়ি টিলা ভুমিতে কাজ করতে গেলে এলাকার প্রতিরোধে প্রসিত বিকাশ সমর্থিত ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফের ৩০/৩৫জন স্বশস্ত্র কর্মীরা বাঙালি কৃষকদের উপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় ১৫/২০জন সেটেলার বাঙালি কৃষক আহত হয়। একপর্যায়ে এলাকাবাসীদের ধাওয়া ও ইউপিডিএফ কর্মীরা ৬০/৭০রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে আতঙ্ক তৈরি করে। এসময় সেটেলার বাঙালি চাষীরা নিজেদের পাহাড় ছেড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য হিরন জয় ত্রিপুরা বলেন, মঙ্গলবার(৮ই এপ্রিল) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রæু চৌধুরী অপু। এসময় তিনি স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের সাথে কথা বলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আহতদের চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ যেকোন নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াবে বলেও জানান তিনি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন