খাগড়াছড়িতে পৌরসভা নির্বাচনে সরব প্রার্থীরা, নিরব ভোটাররা
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পৌরসভার নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে প্রার্থীদের তৎপরতাও ততই বাড়ছে। ছুটছেন ভোটারদের বাড়ি-ঘরে। চলছে উঠোন বৈঠকসহ গণসংযোগ। শহরে চলছে মাইকিং। প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেছে শহরের অলিগলি। কিন্তু প্রার্থীরা সরব হলেও ভোটাররা নিরব। ভোটারদের মধ্যে নেই কোন স্বত:স্ফূর্ততা। সব প্রার্থীকেই আশ্বাস দিলেও মিডিয়ার কাছে মুখ খুলছেন না কেউ। ভোটারদের মাঝে কেমন যেন ভয় ও আতঙ্ক রিবাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিছুক অনেক ভোটারের মতে, ২০১৫সালের পৌরসভা নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতির শিকার হতে চান না তারা। তবে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত। নির্বাচন পর্যবেক্ষক মহলের মতে, খাগড়াছড়ি পৌরসভায় এবার ভোট হবে নিরব বিপ্লব।
দ্বিতীয় ধাপে আগামী ১৬ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য খাগড়াছড়ি পৌরসভায় ভোটার এবার ৩৭হাজার ৮৭জন। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার ২০হাজার ৩৫১জন ও নারী ভোটার ১৬হাজার ৭শ ৩৬জন।
খাগড়াছড়ি পৌরসভায় মেয়র পদে চার, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৪০জন ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ১০জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে মেয়র পদে চার প্রার্থী হলেও মূলত: আলোচনায় আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী নির্মলেন্দু চৌধুরী, বিএনপির ইব্রাহিম খলিল ও আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান মেয়র মো: রফিকুল আলম।
আলোচনায় নেই গত পৌরসভা নির্বাচনে মাত্র ৯৫ভোট পাওয়া জাতীয় পাটির এবারের প্রার্থী ফিরোজ আহমেদ’র।
তার নেই কোন প্রচারণা। এমন কি কোন পোস্টার কিংবা মাইকিং চোখে পড়েনি।
খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন থেকে নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী নির্মলেন্দু চৌধুরী ও বিদ্রোহী প্রার্থী পাল্টা-পাল্টি শো-ডাউন করে মনোনয়নপত্র দাখিল করে। এ সময় শহরে যানজট সৃষ্টি চরম জনদূর্ভোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিল নিরব। এ নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে প্রশাসনও কিছুতা নড়েচড়ে বসে।
এদিকে তিন হেভিয়েট প্রার্থী আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী নির্মলেন্দু চৌধুরী, বিএনপির ইব্রাহিম খলিল ও আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী মো: রফিকুল আলম মাঠ চষে বেড়ালেও ভোটাররা এখনো রয়েছেন নিরব। পৌর শহরের শালবন, কুমিল্লা টিলা, ইসলামপুর, মুসলিমপাড়া, শান্তি নগর, কলেজ গেইট, গোলাবাড়ী রাজ্যমনি পাড়া, বটতলী, ফুটবিলসহ এমন কি বাজারের একাধিক ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে কারো কাছ থেকে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের একটাই বক্তব্য আমরা ২০১৫সালের ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচন পরবর্তি পরিস্থিতির শিকার হতে চায় না।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ, ২০১৫সালের ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পৌরসভা নিবাচনের পর শহরের মানুষ চরম আতঙ্কে দিন পার করেছে। প্রতিনিয়ত শাসকদলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা, মামলার মধ্যে দিন পার করেছে শহরবাসী। এ সময় আওয়ামীলীগের দুই পক্ষের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষে অন্তত তিন ডজন মামলা হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে এক ছাত্রলীগ কর্মী। এছাড়া বর্তমান আওয়ামীলীগের প্রার্থী নির্মলেন্দু চৌধুরী, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো: শানে আলম ও সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রইছ উদ্দিনসহ বহু নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। সংঘাত-সংঘর্ষ খাগড়াছড়ি পৌরসভায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিভিন্ন উপজেলা পর্যন্ত তার প্রভাব পড়ে।
সমতলের সাথে পাহাড়ি এলাকা খাগড়াছড়ির সব কিছুর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে জাতীয় রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি পিসিজেএসএস ও ইউপিডিএফসহ চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের প্রভাব রয়েছে। সে কারণে প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নির্ভর করছে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের উপরও। কারণ এবার পাহাড়ের অন্যতম প্রভাবশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল প্রসিতের ইউপিডিএফ’র সমর্থিত কোন প্রার্থী নেই।
নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেলন্দু চৌধুরীর সর্ব শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের সকাল-থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গণসংযোগ প্রচারণা চালাচ্ছেন। তার পক্ষে কয়েক আগে দিন গণসংযোগ করে গেছেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। এ সময় তিনি হুমকি দিয়ে গেছেন, যারা নেত্রীর সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হবেন, তারা কখনো দলের সদস্য পদ পাবেনা, আওয়ামীলীগের নৌকায় উঠতে পারবেনা।
প্রচার-প্রচারণায় পিছিয়ে নেই ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ও জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল। বিশাল যুব সমাজের কর্মী বাহিনী নিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। তার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক ওয়াদুদ ভূইয়া। তিনি ভয়কে জয় করে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছেন।
বর্তমান পৌর মেয়র মো: রফিকুল আলম নৌকা প্রতীকের প্রত্যাশি থাকলেও শেষ পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের প্রার্থী হিসেবে আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি এবারও মোবাইল প্রতীক নিয়ে জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। জয়ের ব্যাপারে তিনিও আশাবাদী। আর এবার যদি বিজয়ী হন তাহলে তিনি হেড ট্রিক করবেন।
গত পৌরসভাসহ সকল জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে প্রসিতের ইউপিডিএফ প্রার্থী দিলেও এবার নিবাচনী মাঠে তাদের কোন প্রার্থী না থাকায় ভোটের সমীকরণ নিয়ে ভোটার-প্রার্থীরা নানা হিসেব-নিকাশ কষছেন। তার সাথে রয়েছে নতুন প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভোটার।
ভোটের মাঠে আওয়ামীলীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী নির্মলেন্দু চৌধুরী নির্বাচন অবাধ ও সুস্থ হবে দাবি করলেও নানা শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিএনপি প্রার্থী ইব্রাহিম খলিল ও আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো: রফিকুল আলম।
বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল বলেছেন, গণসংযোগ করতে গিয়ে সাধারণ ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। ভোটে যদি সুস্থ পরিবেশ থাকে, জনগণ যদি তার পছন্দের প্রার্থীকে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে তাহলে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয় হবে। বিএনপি প্রার্থী ইব্রাহিম খলিল পেশী শক্তি, প্রভাবমুক্ত, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে দাবি জানিয়ে বলেন, ইভিএম-এ ভোট গ্রহণ নিয়ে সাধারণ মানুষের শঙ্কা রয়েছে। তার মতে, সারাদেশে সরকার নানা কৌশলে জনগণের বিজয় ছিনিয়ে নিচ্ছে। আমরা জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি।
খাগড়াছড়ি পৌর নির্বাচনে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী মো: রফিকুল আলমও ইভিএম নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এবং সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে জনগণ যদি ভোট দিতে পরে তার বিজয় নিশ্চিত দাবি করে ভোট গ্রহণে স্বচছতার মানদন্ড নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন থেকে প্রায়ই সব মেয়র প্রার্থীই গণসংযোগের নামে শক্তি প্রদর্শনের জন্য ব্যাপক শো-ডাউন করে নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে গেলেও এত দিন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন নির্বিকার। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় প্রশাসনেরও টনক নড়েছে। ইতিমধ্যে শহরের বিভিন্ন স্থানে টাঙ্গানো ব্যানার নামানো হয়েছে। আচরণ বিধি লঙ্ঘনের আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো: রফিকুল আলমকে ২০হাজার টাকা, পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী আব্দুল মজিদকে ৫০হাজার টাকা ও জনৈক মেয়র প্রার্থীর পক্ষে মোটর সাইকেলে নির্বাচনী শো-ডাউন করার দায়ে দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের সোবাহানপুর এলাকার এন্তাজ আলীর ছেলে হযরত আলীকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার রাজু আহমেদের দাবি নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণ যোগ্য করার জন্য যা করার দরকার সবই করা হচ্ছে। কোন অপশক্তিকে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবো না। আমরা নির্বাচনে জিরো টলারেন্স নীতিতে শেষ পর্যন্ত থাকবেন। তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকা। এখানে ইউপিডিএফ বলি, কিংবা রাজনৈতিকি সন্ত্রাসী, সংস্কারপহৃী বলি এধরনের বহু গোষ্ঠী-সম্প্রদায় আছে। যারা তাদের স্বার্থ আদায়ে কাজ করার অপচেষ্টা, অপপ্রচার বা অপকর্ম করতে পারে। এ সব অপশক্তি কোন ভাবেই যাতে প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনকে তাদের অনুকূলে নিতে না পারে তার জন্য আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক মহলের মতে, এবার খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে যে কোন প্রার্থীর পক্ষে নিরব ভোট বিপ্লব হবে। এমন প্রার্থীকে সাধারণ মানুষ ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করবেন, অনেকে হবেন হতবাক।
অপরদিকে ক্ষমতাসীনদলের অন্তবর্তীকালীন সরকারের গঠিত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য আ: জব্বার ভাইয়ের নেতৃত্বে ও নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। শনিবার সকাল ৯টা থেকে নৌকা মার্কা লিফলেট হাতে নিয়ে পায়ে হেটে প্রচার প্রচারণায় শুরু করে উন্নয়ন বোর্ড, মাষ্টার পাড়া, কলাবাগান, ভাঙ্গা ব্রীজ, মিলনপুর হয়ে বাজার এলাকায় প্রচারণা চালান এবং নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে বলেন তিনি। এসময় খাগড়াছড়ি পৌরসভার বিভিন্ন নেতা-কর্মী ছাড়াও সাথে অংশ নেন খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ সদস্য মাইন উদ্দিন, শাহিনা আক্তার, জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দিদারুল আলম দিদার প্রমূখ। পরে সন্ধ্যায় তিনি খাগড়াছড়ি পৌর শহরের মুসলিম পাড়া ও শব্দ মিয়া পাড়া (বাঙ্গালকাটি) এলাকায় উঠান বৈঠকে প্রার্থীর সাথে অংশ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন